মাদুরোর বিশাল সেনা ও জনমিলিশিয়া মার্কিন নৌবহরের মোকাবিলায় তৈরি

ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সাড়ে চার মিলিয়নেরও বেশি মিলিশিয়া সদস্য এবং ১৫ হাজার সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে তিনটি যুদ্ধজাহাজ ও চার হাজার মেরিন পাঠানোর পর এই…

Avatar

 

ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সাড়ে চার মিলিয়নেরও বেশি মিলিশিয়া সদস্য এবং ১৫ হাজার সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে তিনটি যুদ্ধজাহাজ ও চার হাজার মেরিন পাঠানোর পর এই ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরোর বিরুদ্ধে পুরস্কারের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ৫০ মিলিয়ন ডলার করেছে এবং তাকে ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ নামক মাদক পাচার সংগঠনের প্রধান বলে অভিযোগ করেছে।

গত সপ্তাহে ক্যারাকাসে হাজারো ভেনেজুয়েলান নাগরিক বলিভারীয় মিলিশিয়ায় নাম লেখাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মিরাফ্লোরেস থেকে শুরু করে সামরিক ব্যারাক পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এবং সরকারি চাকুরীজীবীরা স্বেচ্ছায় এই মিলিশিয়ায় যোগ দিচ্ছে। ৬৬ বছর বয়স্ক অডিটর অস্কার ম্যাথিউস বলেন, “আমি আমার দেশের সেবা করতে এসেছি। আমরা জানি না কী ঘটতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে”।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপের জবাবে মাদুরো কলম্বিয়া সীমান্তে ১৫ হাজার সেনা মোতায়েনের আদেশ দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী দিওসদাদো কাবেলো জানিয়েছেন, জুলিয়া ও তাচিরা রাজ্যে এই বিশাল সৈন্যদল পাঠানো হচ্ছে। এই বাহিনীতে রয়েছে বিমান বাহিনী, নৌ ইউনিট ও ড্রোন। কাবেলো দাবি করেন, এ বছর তারা ৫৩ টন মাদক জব্দ করেছে এবং সীমান্তে অপরাধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে এই মোতায়েন প্রয়োজনীয়।

ট্রাম্প প্রশাসন ইউএসএস গ্রেভেলি, ইউএসএস জেসন ডানহাম ও ইউএসএস স্যাম্পসন নামের তিনটি এজিস গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি জলসীমায় পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে ইউএসএস ইরি গাইডেড মিসাইল ক্রুজার ও ইউএসএস নিউপোর্ট নিউজ পারমাণবিক সাবমেরিনও এই অভিযানে যুক্ত হয়েছে। মোট চার হাজারেরও বেশি নৌসেনা ও মেরিন এই মিশনে অংশ নিচ্ছে।

ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ ঘোষণা করেছেন যে তারাও ক্যারিবীয় উপকূলে যুদ্ধজাহাজ ও ড্রোন মোতায়েন করছে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান, “আমরা আমাদের আঞ্চলিক জলসীমায় বৃহত্তর জলযানসহ উত্তরে আরো ব্যাপক নজরদারি শুরু করেছি”।

এই উত্তেজনার মূলে রয়েছে ট্রাম্পের মাদক বিরোধী অভিযান। আমেরিকান প্রশাসন দাবি করছে যে মাদুরো ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ নামক একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। এই গ্রুপকে ওয়াশিংটন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ভেনেজুয়েলার সরকার এই অভিযোগ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে এটি ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ নামক কোনো সংগঠনের অস্তিত্বই নেই।

মাদুরো টেলিভিশনে ভাষণে বলেন, “সাম্রাজ্যবাদীরা পাগল হয়ে গেছে এবং ভেনেজুয়েলার শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে হুমকি নবায়ন করেছে”। তিনি আরো বলেন, “কোনো সাম্রাজ্য ভেনেজুয়েলার পবিত্র মাটি স্পর্শ করতে পারবে না এবং দক্ষিণ আমেরিকার পবিত্র ভূমিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না”।

বলিভারীয় মিলিশিয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের তৈরি করা একটি সিভিলিয়ান বাহিনী যা ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই মিলিশিয়ায় প্রায় ৫০ লাখ সদস্য রয়েছে, যদিও স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী মিলিশিয়ায় প্রায় ৩.৪৩ লাখ সদস্য রয়েছে।

এই মিলিশিয়ার রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট। তাদের অফিসিয়াল সম্ভাষণ হলো “চাভেজ বেঁচে আছেন!” প্রশিক্ষণের সময় তাদের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকান মেশিনগান, সুইডিশ গ্রেনেড লঞ্চার ও সোভিয়েত আরপিজি লঞ্চার।

ভেনেজুয়েলার জনগণের মাঝে এই সামরিক উত্তেজনা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ আমেরিকান হুমকিকে নিছক রাজনৈতিক থিয়েটার বলে মনে করছেন। একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় প্রায়ই এমন খবর আসে যা সবকিছু বদলে দেবে বলে মনে হয়। আমি মনে করি আমরা অনেকেই এসব নিয়ে ক্লান্ত”।

বিশ্লেষকরা মনে করেন যে প্রকৃত আমেরিকান আক্রমণের সম্ভাবনা কম। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ফিল গানসন বলেন, “আমি মনে করি এটি ভেনেজুয়েলার সরকারি মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি এবং মাদুরোকে কোনো বিষয়ে আলোচনায় বাধ্য করার চেষ্টা”। তবে এই সামরিক মহড়া দেশটিতে ব্যাপক উত্তেজনা ও রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।

বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো নাগরিকদের মিলিশিয়া থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অপর বিরোধী নেতা হেনরিক ক্যাপ্রিলেস ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করে বলেছেন, “আমি ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণের দৃঢ় নিন্দা জানাই। আমাদের দেশের মাটি পবিত্র এবং তা অলঙ্ঘনীয়”।

লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশও এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউম বলেছেন, “এই অঞ্চলে আমাদের বার্তা হলো হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এটি শুধু একটি বিশ্বাস নয়, এটি আমাদের সংবিধানে আছে”। কলম্বিয়া ও কিউবাসহ একাধিক দেশ আমেরিকান নৌ মোতায়েনকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছে।

এদিকে ভেনেজুয়েলা জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে যে আমেরিকান সামরিক মোতায়েন আন্তর্জাতিক আইনের “স্পষ্ট লঙ্ঘন” এবং এটি “আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি”। ভেনেজুয়েলা বিশেষভাবে পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন মোতায়েনকে “স্পষ্ট ভীতি প্রদর্শন” বলে উল্লেখ করেছে।

বর্তমান পরিস্থিতি ট্রাম্পের ল্যাটিন আমেরিকান মাদক কার্টেলের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির অংশ। তিনি গত মাসে গোপন নির্দেশনা জারি করে পেন্টাগনকে নির্দিষ্ট ল্যাটিন আমেরিকান মাদক কার্টেলের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। এই কার্টেলগুলোকে বিদেশি “সন্ত্রাসী” গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই ব্যাপক সামরিক মোতায়েন ও পাল্টা প্রস্তুতির মধ্যে ক্যারিবীয় অঞ্চলে নতুন একটি সংকট দেখা দিয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন, তবুও এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম