দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের কালীপুজোর মহাভোগ বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রসাদের মধ্যে একটি। প্রতি বছর কালীপুজোর দিন এখানে হাজার হাজার ভক্ত মহাভোগ গ্রহণের জন্য ভিড় করেন। কিন্তু এই বিশাল আয়োজনের পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা কাহিনি।
মহাভোগের প্রস্তুতি শুরু হয় পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই। মন্দিরের পাশেই বিশাল রান্নাঘরে দিনরাত চলে রান্নার কাজ। প্রায় ১০০ জন রাঁধুনি ও সহকারী মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন যাতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের জন্য প্রসাদ তৈরি করা যায়।
মহাভোগের মূল উপাদান হল খিচুড়ি, লাবড়া, পাঁচমিশালি তরকারি, চাটনি ও পায়েস। খিচুড়ির জন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের চাল ও ডাল। লাবড়ার জন্য লাগে কুমড়ো, আলু, বেগুন সহ নানা সবজি। পাঁচমিশালি তরকারিতে থাকে পাঁচ রকমের সবজি। চাটনি হয় আমের এবং পায়েস তৈরি হয় দুধ, চাল ও চিনি দিয়ে।
রান্নার জন্য ব্যবহৃত উপকরণগুলি সব কিছুই খাঁটি ও উচ্চমানের। বিশেষ করে ঘি, তেল, মসলা ইত্যাদি নির্বাচনে খুব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কারণ এটি শুধু খাবার নয়, মায়ের প্রসাদ। তাই এর স্বাদ ও মান অতুলনীয় হওয়া চাই।
রান্নার সময় বিশেষ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। রাঁধুনিরা সবাই স্নান করে পবিত্র হয়ে রান্নায় অংশ নেন। রান্নার সময় কোনো কথা বলা নিষেধ। শুধু মা কালীর নাম জপ করতে হয়। এতে করে রান্নায় মায়ের আশীর্বাদ থাকে বলে বিশ্বাস।
বড় বড় কড়াইয়ে একসঙ্গে প্রায় ৫০০ কেজি খিচুড়ি রান্না করা হয়। লাবড়ার জন্যও একই পরিমাণ সবজি লাগে। পায়েসের জন্য প্রায় ১০০০ লিটার দুধ ব্যবহার করা হয়। এত বড় পরিমাণে রান্না করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় রাঁধুনিরা এটি নিখুঁতভাবে করে থাকেন।
রান্না শেষ হলে সেগুলি বড় বড় হাঁড়িতে ভরে রাখা হয়। তারপর শুরু হয় পরিবেশনের পালা। হাজার হাজার মানুষকে একসঙ্গে প্রসাদ দেওয়া একটি কঠিন কাজ। কিন্তু সুন্দর পরিকল্পনা ও দক্ষতার সাথে এটি করা হয়। লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা ভক্তদের একে একে প্রসাদ দেওয়া হয়।
মহাভোগের স্বাদ অতুলনীয়। খিচুড়ির সাথে লাবড়া ও তরকারির মিশ্রণ অপূর্ব। চাটনির টক ও পায়েসের মিষ্টি স্বাদ মুখে জল এনে দেয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা হল এটি মায়ের প্রসাদ। তাই ভক্তরা শ্রদ্ধাভরে এটি গ্রহণ করেন।
দক্ষিণেশ্বরের মহাভোগের খ্যাতি শুধু কলকাতায় নয়, সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে শুধু এই প্রসাদ খাওয়ার জন্যই দূর-দূরান্ত থেকে আসেন। প্রতি বছর প্রায় ৫ লক্ষ ভক্ত এখানে মহাভোগ গ্রহণ করেন।
মাত্র ১০ হাজার টাকায় ২৫টি লাভজনক ব্যবসার আইডিয়া: কম পুঁজিতে বড় লাভের সুযোগ
মহাভোগের এই ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল রানী রাসমণির আমল থেকে। তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই প্রথা চালু করেন। পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সময় এটি আরও বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন এই ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে।
মহাভোগের জন্য প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এই অর্থ আসে ভক্তদের দান থেকে। অনেক ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই কাজে সাহায্য করেন। এছাড়া মন্দিরের নিজস্ব আয় থেকেও কিছু অর্থ ব্যয় করা হয়।
মহাভোগের পাশাপাশি দক্ষিণেশ্বরে কালীপুজোর আরও অনেক আকর্ষণ রয়েছে। সারারাত ধরে চলে পুজো ও আরতি। হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় ঝলমল করে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ। ভক্তরা গান-বাজনা ও নৃত্যের মাধ্যমে মাকে আরাধনা করেন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে ভক্তদের ভিড়। অনেকে সারারাত জেগে থাকেন মায়ের দর্শনের আশায়। পুজোর পর ভোরে যখন মায়ের ঘোমটা খোলা হয়, তখন সেই দৃশ্য দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে।
দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি সামাজিক মিলনমেলাও বটে। নানা শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে একত্রিত হন। ধনী-গরিব, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সবাই একসাথে বসে মহাভোগ গ্রহণ করেন। এভাবে এটি সামাজিক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
মহাভোগের মাধ্যমে দক্ষিণেশ্বর শুধু ভক্তদের খাদ্যই দেয় না, তাদের মনেও শান্তি ও আনন্দ দেয়। এই প্রসাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভক্তরা অনুভব করেন মায়ের আশীর্বাদ। তাই এটি তাদের কাছে শুধু খাবার নয়, একটি পবিত্র অনুভূতি।
বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতির কারণে মহাভোগের আয়োজনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে এতে মহাভোগের মাহাত্ম্য কমেনি, বরং ভক্তদের মধ্যে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
সামগ্রিকভাবে দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজোর মহাভোগ একটি অনন্য ঐতিহ্য। এটি শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মহাভোগের স্বাদ নিয়ে ফিরে যান। তাদের মনে থেকে যায় মায়ের আশীর্বাদের স্পর্শ। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই অনন্য ঐতিহ্য, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।