মহালয়ার তিথিতেই দেবী সংসার নিয়ে মর্তে আসেন— বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার সেই পুণ্য প্রভাত

মহালয়ার তিথি মানেই বাঙালির জীবনে এক অন্যরকম রকম অনুভূতি। পিতৃপক্ষের সমাপ্তি আর দেবীপক্ষের সূচনার সেই পবিত্র সন্ধিক্ষণে, যখন পুরনো রেডিয়োর তরঙ্গে ভেসে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর অমর স্তোত্রপাঠ।…

Avatar

 

মহালয়ার তিথি মানেই বাঙালির জীবনে এক অন্যরকম রকম অনুভূতি। পিতৃপক্ষের সমাপ্তি আর দেবীপক্ষের সূচনার সেই পবিত্র সন্ধিক্ষণে, যখন পুরনো রেডিয়োর তরঙ্গে ভেসে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর অমর স্তোত্রপাঠ। এবছর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রবিবার মহালয়ার এই পুণ্য লগ্নে আবারো ধ্বনিত হবে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা।

হিন্দু পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, মহালয়ার অমাবস্যা তিথি শুরু হবে ২০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫৪ মিনিট থেকে এবং স্থায়ী হবে ২১ সেপ্টেম্বর রাত পর্যন্ত। এই বিশেষ দিনটিতে দেবী দুর্গা পরিবার নিয়ে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের উদয়

মহালয়া শব্দটির অর্থ ‘মহান আলয়’ বা আশ্রম। এই শব্দে স্বয়ং দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আশ্রয়। মহালয়ার এই বিশেষ দিনটি পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের মধ্যে সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত। পিতৃপক্ষের শেষদিনে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার পর, মহালয়ার অমাবস্যা পেরিয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষ।

বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুর নিধনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। শাস্ত্রমতে এই তিথিতে দেবীর চক্ষুদান হয় এবং মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা, যা পূর্ণতা পায় বিজয়া দশমীতে।

মহিষাসুরমর্দিনীর কালজয়ী যাত্রা

পুরনো রেডিয়ো বার করে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার যে ঐতিহ্য, তার শুরু ১৯৩২ সালে। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র—এই তিন কিংবদন্তীর হাতে গড়ে উঠেছিল এই অনুষ্ঠান। প্রথমদিকে ‘বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান’ হিসেবে প্রচারিত হত, পরে ১৯৩৭ সালে এর নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।

আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত এই দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে রয়েছে শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে গৃহীত দেবী চণ্ডীর স্তোত্র, বাংলা ভক্তিগীতি, ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং পৌরাণিক কাহিনীর নাট্যরূপ। প্রথমদিকে সরাসরি প্রচারিত হলেও, ১৯৬৬ সাল থেকে পূর্বরেকর্ডকৃত অনুষ্ঠানই প্রচার করা হয়।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমর কণ্ঠস্বর

১৯০৫ সালে উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মাত্র আট বছর বয়সে প্রথম চণ্ডীপাঠ করে সকলকে চমৎকৃত করেছিলেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্ব অনায়াসে চল্লিশ-পঞ্চাশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে পারতেন।

উত্তমকুমার একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্থলাভিষিক্ত হতে চেয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। কিন্তু বাঙালির আবেগময় প্রতিবাদের মুখে আকাশবাণী সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাই প্রমাণ করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং মহিষাসুরমর্দিনী কতখানি একাত্ম হয়ে গিয়েছে বাঙালির হৃদয়ে।

দেবীর মর্ত্যলোকে আগমনের তাৎপর্য

পুরাণ অনুযায়ী মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা পরিবার সহ মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের তেজরাশি থেকে উৎপন্ন এই মহামায়ারূপী দেবী মহিষাসুরকে বধ করার জন্য মর্ত্যে আসেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, দেবতাদের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মহিষাসুরকে নিধন করেন দুর্গা।

এবছর ২০২৫ সালে দেবী দুর্গার আগমন হবে গজে (হাতিতে), যা শুভ লক্ষণ। গজে আগমন মানে শান্তি ও সমৃদ্ধির সূচক, বসুন্ধরা হয়ে উঠবে শস্যশ্যামলা। তবে গমন হবে দোলায় (পালকিতে), যার ফলে কিছুটা অশুভ আশঙ্কা রয়েছে।

মহালয়ার দিনের বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান

মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার রীতি রয়েছে। তামার ঘটিতে কাঁচা দুধ, কালো তিল, আতপ চাল, সাদা ফুল এবং গঙ্গাজল মিশিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে ঢেলে দেওয়া হয়। এই দিন নিরামিষ খাবার খাওয়া এবং দরিদ্রদের দান করা শুভ বলে মনে করা হয়।

মহালয়ার দিন কিছু বিষয় এড়িয়ে চলা উচিত। চুল-দাড়ি নখ কাটা, কাউকে ধার দেওয়া, নতুন কিছু কেনাকাটা এবং আমিষ খাবার খাওয়া এই দিনে নিষিদ্ধ। কোনও ভিক্ষুক যেন খালি হাতে না ফিরে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিক কালের মেলবন্ধন

বিগত ৯০ বছরের বেশি সময় ধরে এই অনুষ্ঠান শুধু একটি রেডিয়ো প্রোগ্রাম নয়, হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেটের যুগেও এই প্রভাতী অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। মহালয়ার সকালে বাঙালির মন ছুঁয়ে যায় এই অনুষ্ঠানের মধুর স্বরলহরী।

আধুনিক প্রজন্মের কাছেও মহিষাসুরমর্দিনী সমান গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও তরুণরা এই অনুষ্ঠান শুনে পুজোর আবহ অনুভব করে। কাশফুলের সাদা গুচ্ছ, শিউলি তোলার সকাল আর খেজুরের রসের গন্ধ—সব কিছু মিলে তৈরি হয় এক অনন্য পরিবেশ।

পুজোর প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ আয়োজন

মহালয়ার পর ঠিক এক সপ্তাহ বাদে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে দুর্গাপুজোর মূল আয়োজন। মহাষষ্ঠী ২৮ সেপ্টেম্বর, মহাসপ্তমী ২৯ সেপ্টেম্বর, মহাষ্টমী ৩০ সেপ্টেম্বর, মহানবমী ১ অক্টোবর এবং বিজয়া দশমী ২ অক্টোবর।

মহালয়ার পর থেকেই পুজোর প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। প্যান্ডেল নির্মাণ, মূর্তি তৈরি, নতুন পোশাক কেনাকাটা—সব কিছু মিলে বাঙালির জীবনে নেমে আসে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। এই সময় থেকেই ঢাকের আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার প্রতিটি প্রান্ত।

আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। ২১ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় আকাশবাণীর তরঙ্গে ভেসে আসবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমর কণ্ঠে “যা দেবী সর্বভূতেষু”—মহিষাসুরমর্দিনীর সেই কালজয়ী আহ্বান। পুরনো রেডিয়ো বের করে বসার সময় হয়ে এল আবার, দেবী দুর্গার আগমনী সুরে মাতৃভূমি বাংলার ঘরে ঘরে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম