Mahalaya Karna Mythology: মহালয়া হল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তিথি যা পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং দেবীপক্ষের শুরুর দিন হিসেবে পালিত হয়। এই দিনে অনেকে গঙ্গাস্নান করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান ও তর্পণ করেন। ‘মহালয়া’ শব্দটির অর্থ হল মহৎ আলয় বা বৃহৎ আবাস। কিছু মতে এর অর্থ প্রেতের আলয়ও বলা হয়। মহালয়ার সাথে মহাভারতের একটি গভীর যোগাযোগ রয়েছে, যা এই দিনটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
মহালয়া অমাবস্যা ২০২৪: পিতৃপক্ষের শেষ দিনে কী করবেন, জেনে নিন তারিখ, সময় ও তাৎপর্য
মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুর পর কর্ণ যখন স্বর্গে পৌঁছালেন, তখন তাঁকে খাদ্য-পানীয়ের পরিবর্তে কেবল সোনা-রূপার মতো ধাতু খেতে দেওয়া হল। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি দেখে কর্ণ প্রশ্ন করলেন এর কারণ। তখন তাঁকে জানানো হল যে তিনি সারা জীবন শুধু শক্তির আরাধনা করেছেন, কিন্তু কখনও নিজের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেননি বা তাঁদের প্রয়াত আত্মার জন্য খাদ্য-পানীয় দান করেননি। এই কারণে তিনি স্বর্গে আসতে পারলেও খাদ্য-পানীয় পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।
এই ঘটনার পর কর্ণ পৃথিবীতে ফিরে আসার অনুমতি চাইলেন যাতে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। তাঁকে পনেরো দিনের অনুমতি দেওয়া হল। এই পনেরো দিন ধরে কর্ণ প্রতিদিন পৃথিবীতে এসে তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতেন। এই পনেরো দিনের শেষ দিনটিই হল মহালয়া, যা পরবর্তীতে পিতৃপক্ষের শেষ দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
মহালয়ার দিনে বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হল ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্তোত্রপাঠ শোনা। এই অনুষ্ঠানটি ৮৫ বছর ধরে একইভাবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৩১ সালে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের নির্দেশনায় প্রথম এই সংগীতময় অনুষ্ঠানটি রচিত হয়। বণিকুমারের লেখা স্ক্রিপ্টটি মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবী দুর্গার সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা, স্তোত্র এবং বাংলা ভক্তিগীতির একটি সংমিশ্রণ।
মহালয়ার দিনে অনেক হিন্দু পরিবার গঙ্গা বা অন্য নদীতে তর্পণ করেন। এই অনুষ্ঠানে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ‘পিণ্ডদান’ করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে পিতৃপুরুষেরা পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। তাঁদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তৃপ্ত করা হয় বলেই মহালয়া একটি পুণ্য তিথি হিসেবে বিবেচিত হয়।
মহালয়ায় শুধু পিতৃপুরুষদের জন্যই নয়, বরং দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য-পিতৃ তর্পণও করা হয়। এমনকি রাম তর্পণ ও লক্ষ্মণ তর্পণও করা হয়। এই দিনে ত্রিভুবনের সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি যাঁদের জন্ম-জন্মান্তরে কোনও আত্মীয়-বন্ধু নেই, তাঁদের জন্যও তর্পণ করা হয়।
মহালয়ার সাথে দুর্গাপূজার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই দিন থেকেই দেবী দুর্গার আগমনের প্রস্তুতি শুরু হয়। বিশ্বাস করা হয় যে মহালয়ার দিন থেকে দেবী দুর্গা কৈলাস পর্বত থেকে মর্ত্যলোকে নেমে আসতে শুরু করেন। তিনি তাঁর সন্তানদের – গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে নিয়ে এক সপ্তাহব্যাপী যাত্রা করেন। এই যাত্রায় তিনি বিভিন্ন বাহন ব্যবহার করেন, যেমন পালকি, নৌকা, হাতি বা ঘোড়া।
রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী, ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজা বসন্তকালে হওয়াই নিয়ম। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র অকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে একে ‘অকাল বোধন’ বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজের আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। লঙ্কা বিজয়ের আগে শ্রীরামচন্দ্র এমনটাই করেছিলেন। সেই থেকে মহালয়ায় তর্পণ অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
মহালয়ার দিনে প্রতিমার চোখ আঁকা হয় রেওয়াজ মেনে, যদিও এর পিছনে নির্দিষ্ট কোনও শাস্ত্রীয় নিয়ম নেই। এই দিনটি আসলে পিতৃপক্ষের অবসানকে চিহ্নিত করে। পূর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।মহালয়ার দিনে বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই ৯০ মিনিটের সংগীতময় অনুষ্ঠানটি প্রথম রচিত হয় ১৯৩১ সালে। দীর্ঘ আট দশক পরেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় এই অনুষ্ঠানটি প্রতি বাঙালির হৃদয়ে একই আবেগ জাগায়। অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কণ্ঠে এই অনুষ্ঠান প্রচারের চেষ্টা করলেও কোনওটাই ভদ্রের কণ্ঠের মতো জনপ্রিয়তা পায়নি।
মহালয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর নামক অসুরকে পরাজিত করে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এই বিজয়কে স্মরণ করতেই আমরা মহালয়া পালন করি। এই ঘটনা শুধু একটি ধর্মীয় কাহিনীই নয়, এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্যের শক্তি, সাহসের মূল্য এবং সেই সার্বজনীন সত্য যে শেষ পর্যন্ত ভালো সবসময় মন্দকে পরাজিত করে।মহালয়ার দিনে অনেক হিন্দু পরিবারে উপবাস পালন করা হয়। কেউ কেউ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস করেন, আবার কেউ কেউ শুধু ফলাহার করেন। এই উপবাসের মাধ্যমে শরীর ও মনকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই শুদ্ধতা আগত উৎসবের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করে।
মহালয়ার দিনে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ খাবারের প্রচলন রয়েছে। অনেক পরিবারে এই দিনে খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুন ভাজা, পাঁপড় ভাজা ইত্যাদি রান্না করা হয়। এছাড়া নানা ধরনের মিষ্টি যেমন পায়েস, রসগোল্লা, সন্দেশ ইত্যাদিও তৈরি করা হয়। এই খাবারগুলি শুধু খাদ্যের প্রয়োজন মেটায় না, বরং পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সংযোগকেও মজবুত করে।মহালয়ার দিনে অনেক মন্দিরে বিশেষ পূজা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা স্থাপন করা হয় এবং বিশেষ আরতি ও মন্ত্রপাঠ করা হয়। অনেক স্থানে সারা রাত ধরে কীর্তন ও ভজন গাওয়া হয়। এই সব আয়োজন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে একত্রিত করে এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে।মহালয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর সাংস্কৃতিক প্রভাব। এই দিনটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।