বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদন্তি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। ১৮ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি দেশের হয়ে অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। বুধবার (১২ মার্চ ২০২৫) সন্ধ্যায় তিনি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্টের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত জানান। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে আগেই অবসর নেওয়া এই তারকা এবার ওয়ানডেসহ সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেন। তাঁর এই ঘোষণায় ভক্ত-সমর্থকদের মনে আনন্দের সঙ্গে মিশে গেছে বিষাদের ছায়া।
ঘটনার বিবরণে যেতে গেলে দেখা যায়, মাহমুদউল্লাহর এই সিদ্ধান্ত খুব হঠাৎ করে আসেনি। গত কয়েক মাস ধরেই তাঁর অবসর নিয়ে গুঞ্জন চলছিল। বিশেষ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার পর তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। রাওয়ালপিন্ডিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর শেষ ওয়ানডে ম্যাচে মাত্র ৪ রান করেন তিনি। এরপর থেকেই তাঁর ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অবশেষে ১২ মার্চ রাতে ফেসবুকে তিনি লেখেন, “সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “সবকিছু সবসময় নিখুঁতভাবে শেষ হয় না, তবু সামনে এগিয়ে যেতে হয়। শান্তি… আলহামদুলিল্লাহ।” এই পোস্টের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ দল ও দেশের ক্রিকেটের জন্য শুভকামনাও জানিয়েছেন।
মাহমুদউল্লাহর ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। প্রথমে তিনি ওয়ানডেতে অভিষেক করেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বাংলাদেশ দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। টেস্ট ক্রিকেট থেকে তিনি অবসর নেন ২০২১ সালের জুলাইয়ে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টের পর। সেখানে তিনি ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায় নেন ২০২৪ সালের অক্টোবরে, ভারতের বিপক্ষে সিরিজের পর। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ওয়ানডেতে তিনি খেলা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু এবার তিনি সব ফরম্যাট থেকেই সরে দাঁড়ালেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের আগে গত ১০ মার্চ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) জানায়, মাহমুদউল্লাহ নিজেই ২০২৫ সালের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এটি ছিল তাঁর অবসরের একটি বড় ইঙ্গিত।
তাঁর ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ানডেতে ২৩৮ ম্যাচ খেলে তিনি ৫,৩৮৬ রান করেছেন, যার মধ্যে ৪টি সেঞ্চুরি ও ৩২টি ফিফটি রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এই ফরম্যাটে। টেস্টে ৫০ ম্যাচে ২,৯১৪ রান ও ৪৩ উইকেট এবং টি-টোয়েন্টিতে ১৩৯ ম্যাচে ২,৪২৫ রানের সঙ্গে ৪২ উইকেট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এছাড়া তিনি দলের অধিনায়কও ছিলেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি (২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে) তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছিল। এই ধরনের পারফরম্যান্স তাঁকে ‘মিস্টার ফিনিশার’ বা ‘সাইলেন্ট কিলার’ হিসেবে ভক্তদের কাছে পরিচিত করে তুলেছে।
এই অবসরের পেছনে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ও রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। মুশফিকুর রহিমও গত ৫ মার্চ ওয়ানডে থেকে অবসর নেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই কিংবদন্তির বিদায়ে বাংলাদেশের ‘পঞ্চপাণ্ডব’ যুগেরও সমাপ্তি ঘটল। তামিম ইকবাল আগেই অবসর নিয়েছেন, সাকিব আল হাসানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদিন ফাহিম গত মাসে বলেছিলেন, মাহমুদউল্লাহ অবসরের কথা ভাবছেন। তাঁর মতে, এটি দলের ভবিষ্যতের জন্যও সঠিক সময়।
মাহমুদউল্লাহর এই বিদায় অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই এলো। তিনি নিজেই বলেছেন, শেষটা সবসময় নিখুঁত হয় না। ভক্তরা আশা করেছিলেন, মাঠে তাঁর শেষ ম্যাচটা হবে স্মরণীয়। কিন্তু তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে শান্তভাবে বিদায় নিলেন। তাঁর পোস্টে পরিবার, সতীর্থ ও সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি। বিশেষ করে ছেলে রায়েদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, “রায়েদ আমাকে লাল-সবুজ জার্সিতে মিস করবে।” এই আবেগঘন বার্তা ভক্তদের মন ছুঁয়ে গেছে।
মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি স্বর্ণযুগের প্রতীক। তাঁর বিদায়ে একটি অধ্যায় শেষ হলেও, তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য তিনি থাকবেন অনুপ্রেরণা। তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়। এখন দলের দায়িত্ব তুলে নেবে নতুন প্রজন্ম। মাহমুদউল্লাহর জন্য রইল শুভকামনা ও ভালোবাসা।