মালয়েশিয়া কলিং ভিসা আবেদন ২০২৬: সম্পূর্ণ গাইড যা আপনার জীবন বদলে দিতে পারে

মালয়েশিয়ায় কাজের সুযোগ খুঁজছেন? হাজার হাজার বাংলাদেশির মতো আপনিও হয়তো স্বপ্ন দেখছেন একটি বৈধ কলিং ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু জটিল প্রক্রিয়া, প্রতারণার ভয়, আর অস্পষ্ট তথ্য হয়তো আপনাকে…

Ishita Ganguly

 

মালয়েশিয়ায় কাজের সুযোগ খুঁজছেন? হাজার হাজার বাংলাদেশির মতো আপনিও হয়তো স্বপ্ন দেখছেন একটি বৈধ কলিং ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু জটিল প্রক্রিয়া, প্রতারণার ভয়, আর অস্পষ্ট তথ্য হয়তো আপনাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছে। এই সম্পূর্ণ গাইডে আমরা শুধু তথ্য দেব না, দেখাবো কীভাবে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী উপায়ে মালয়েশিয়া কলিং ভিসা আবেদন করতে হয়।

মালয়েশিয়া কলিং ভিসা কী এবং কেন এটি বাংলাদেশিদের প্রথম পছন্দ

মালয়েশিয়া কলিং ভিসা হলো একটি কর্মসংস্থান চুক্তি ভিত্তিক অভিবাসন সুযোগ যেখানে মালয়েশিয়ার একটি নিবন্ধিত কোম্পানি সরাসরি বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এটি মূলত একটি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা যা আপনাকে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় কাজ করার অধিকার দেয়। ২০২৫ সালে এই ভিসা প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও ডিজিটাল হয়েছে, যা প্রতারণার সুযোগ কমিয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

কলিং ভিসা বনাম অন্যান্য ভিসার মৌলিক পার্থক্য

অনেকেই ট্যুরিস্ট ভিসা আর কলিং ভিসার পার্থক্য বোঝেন না, ফলে পরে নানা সমস্যায় পড়েন। কলিং ভিসায় আপনার একটি নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা থাকে, কাজের চুক্তি থাকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এটি সম্পূর্ণ বৈধ। ট্যুরিস্ট ভিসায় কাজ করা অবৈধ এবং ধরা পড়লে জেল-জরিমানা সহ স্থায়ীভাবে মালয়েশিয়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

স্টুডেন্ট ভিসায় সীমিত সময়ের পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ থাকলেও, কলিং ভিসায় আপনি ফুল-টাইম কাজ করতে পারবেন এবং রেমিটেন্স পাঠাতে পারবেন নিয়মিত। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন—ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সময় কলিং ভিসায় দীর্ঘ হলেও (সাধারণত ২-৪ মাস), এটি আপনার দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়।

পাসপোর্ট নাম্বার দিয়ে ভিসা চেক করার সম্পূর্ণ গাইড ২০২৫: সহজ এবং নিরাপদ উপায়

২০২৫ সালের নতুন নিয়ম যা আপনার জানা জরুরি

চলতি বছরে মালয়েশিয়া সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। প্রথমত, সব বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন এখন “আমি প্রবাসী” অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল হয়েছে, যা স্বচ্ছতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগকর্তা যাচাইকরণ প্রক্রিয়া কঠোর হওয়ায় ভুয়া কোম্পানির সংখ্যা কমেছে। তৃতীয়ত, VDR অনুমোদন (ভিসা উইথ রেফারেন্স) এখন আগের চেয়ে দ্রুত প্রক্রিয়া হচ্ছে—বিশেষ করে ফ্যাক্টরি সেক্টরে।

মালয়েশিয়া সরকার ২০২৫ সালে নির্দিষ্ট কিছু সেক্টরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য কোটা বাড়িয়েছে, বিশেষত ইলেকট্রনিক্স, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পাম অয়েল শিল্পে। এর মানে হলো, চাকরির সেক্টর অনুযায়ী আপনার সুযোগও বেড়েছে। তবে সাবধান—মেডিকেল ও নিরাপত্তা যাচাই এখন আরও কঠোর, তাই মেডিকেল টেস্ট এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে কোনো ধরনের অসততা করার চিন্তাও করবেন না।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার বিশেষ সুবিধা

আমার পরিচিত একজন মিস্ত্রি ২০২৩ সালে ঢাকায় মাসে ১৮ হাজার টাকা আয় করতেন। মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় যাওয়ার পর এখন তার মাসিক আয় ১৬০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৪০ হাজার টাকা), এবং ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে ৫৫-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠাতে পারেন। এটাই কলিং ভিসার বাস্তব সুবিধা।

মালয়েশিয়ায় বেতন কাঠামো আইন দ্বারা সুরক্ষিত। ন্যূনতম মজুরি ১৫০০ রিঙ্গিত নিশ্চিত করা হয়েছে বিদেশি শ্রমিকদের জন্যও। দক্ষ পেশাজীবীরা (ওয়েল্ডার, ইলেকট্রিশিয়ান) প্রায়ই ১৮০০-২০০০ রিঙ্গিতও পেয়ে থাকেন। এছাড়া মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিক কল্যাণে বিশেষ মনোযোগী—আপনার থাকা-খাওয়ার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে কঠোর নিয়ম আছে।

ভাষাগত দিক থেকেও সুবিধা রয়েছে। মালয়েশিয়ায় প্রচুর বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে যারা নতুনদের সাহায্য করেন। ঢাকার বাংলাদেশ হাই কমিশন কুয়ালালামপুরে সক্রিয় থাকে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা দেয়।

আবেদনের যোগ্যতা: আপনি কি প্রস্তুত?

শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতার বাস্তব চিত্র

মালয়েশিয়া কলিং ভিসার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ভর করে আপনি কোন চাকরির সেক্টর এ যেতে চান তার উপর। সাধারণ ফ্যাক্টরি বা নির্মাণ কাজের জন্য অষ্টম শ্রেণী পাশ হলেই চলে, তবে কিছু কোম্পানি এসএসসি পাশ চায়। আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সনদ অবশ্যই সত্যায়িত হতে হবে—ভুয়া সনদ ব্যবহার করলে ভিসা বাতিল হওয়ার পাশাপাশি ব্ল্যাকলিস্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে।

দক্ষ পেশার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, মেশিন অপারেটর—এসব পেশায় আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রমাণ লাগবে। অনেক কোম্পানি ট্রেড টেস্ট নেয়। আমার এক আত্মীয় ওয়েল্ডার হিসেবে আবেদন করেছিলেন, কিন্তু ইন্টারভিউতে তার প্রকৃত দক্ষতা যাচাই করা হয়। কাজেই সার্টিফিকেট নিয়ে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না—পরে আরও বড় সমস্যা হবে।

বয়স সীমা এবং শারীরিক সক্ষমতার গুরুত্ব

মালয়েশিয়া কলিং ভিসার জন্য সাধারণত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়স গ্রহণযোগ্য। তবে কিছু কোম্পানি ৪০ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে, আবার কিছু সেক্টরে ৫০ বছর পর্যন্ত নিয়োগ দেয়। শারীরিক সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ মেডিকেল টেস্ট এ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, যক্ষ্মা এবং সংক্রামক রোগের পরীক্ষা হয়।

এইচআইভি এবং হেপাটাইটিস বি/সি পজিটিভ হলে আপনার ভিসা প্রায় নিশ্চিত প্রত্যাখ্যাত হবে। কিডনি বা লিভারের জটিল সমস্যা থাকলেও ঝুঁকি আছে। তাই আবেদনের আগে নিজেই একটা জেনারেল চেকআপ করে নিন—এতে হঠাৎ করে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার হতাশা এড়াতে পারবেন।

যে পেশাগুলো নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ

মালয়েশিয়া সরকার কিছু পেশায় বিদেশি শ্রমিক নেয় না। ড্রাইভিং (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে), সিকিউরিটি গার্ড, ছোট দোকানের বিক্রয়কর্মী—এসব পেশায় স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কাজেই এসব পেশায় কলিং ভিসা দেওয়ার কথা বললে বুঝবেন হয় কোম্পানি তথ্য ভুল দিচ্ছে, নয়তো এটা প্রতারণা। প্রতারণা এড়ানোর উপায় হিসেবে মালয়েশিয়া সরকারের অফিশিয়াল সাইটে অনুমোদিত পেশার তালিকা দেখে নিন।

বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন: প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

“আমি প্রবাসী” অ্যাপ: আপনার ডিজিটাল পাসপোর্ট

বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মালয়েশিয়া কলিং ভিসা একদম অসম্ভব। ২০২৫ সালে সব কিছু “আমি প্রবাসী” অ্যাপে চলে এসেছে, যা গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে হয়। আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে লগইন করে সব তথ্য দিতে হবে—নাম, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা ইত্যাদি।

অ্যাপে ছবি আপলোড, ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া এবং আপনার সব সনদপত্র স্ক্যান করে জমা দিতে হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সাধারণত ৫০০-১০০০ টাকা খরচ হয়। মনে রাখবেন, এই অ্যাপে যে তথ্য দেবেন তা সত্য হতে হবে—পরবর্তীতে ডকুমেন্ট যাচাইকরণ পর্যায়ে মিথ্যা ধরা পড়লে আপনার পুরো প্রক্রিয়া বাতিল হবে।

অনলাইন ও অফলাইন আবেদনের ধাপগুলো

অনলাইনে অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করলেও, কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে স্থানীয় বিএমইটি অফিসে যেতে হতে পারে। আপনার পাসপোর্ট বৈধতা চেক করা, বায়োমেট্রিক সংগ্রহ এবং মূল দলিলপত্র যাচাইয়ের জন্য একবার হলেও উপস্থিত হতে হয়। ৬৪ জেলার বিএমইটি অফিসের মধ্যে ৪২টি সক্রিয়ভাবে মালয়েশিয়া কলিং ভিসার কাজ করছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট—এসব বড় শহরে প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। ছোট জেলাগুলোতে কিছুটা বেশি সময় লাগতে পারে। আবেদন জমা দেওয়ার সময় একটা রসিদ নম্বর পাবেন—এটা সযত্নে রাখবেন। এই নম্বর দিয়ে আপনার আবেদনের অগ্রগতি ট্র্যাক করতে পারবেন। ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সময় জানতে নিয়মিত চেক করুন।

রেজিস্ট্রেশন ফি এবং সময়সীমার বাস্তবতা

বিএমইটি রেজিস্ট্রেশনে ভিসা আবেদন ফি হিসেবে প্রায় ৪,০০০-৬,০০০ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে আছে স্মার্ট কার্ড ফি, প্রশিক্ষণ ফি এবং প্রসেসিং চার্জ। অনেক সময় মেডিকেল এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রথম পর্যায়ে ১০-১৫ হাজার টাকা লাগতে পারে। রেজিস্ট্রেশনের পর অনুমোদন পেতে সাধারণত ১৫-৩০ দিন সময় লাগে যদি সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে।

তবে যদি কোনো তথ্য ভুল পাওয়া যায় বা অতিরিক্ত যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়, তাহলে ৬০ দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারে। কাজেই ধৈর্য ধরুন এবং নিয়মিত ফলো-আপ করুন। যদি দেখেন ৪৫ দিনেও কোনো সাড়া নেই, তাহলে সরাসরি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিন—কখনো কখনো সিস্টেমে গোলমাল হয় বা কাগজপত্র আটকে যায়।

প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস: একটিও বাদ দিলে আটকে যাবেন

পাসপোর্ট: আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল

মালয়েশিয়া কলিং ভিসার জন্য আপনার পাসপোর্টে অবশ্যই ১৮ মাসের বৈধতা থাকতে হবে। অনেকে ১২ মাস থাকলেই আবেদন করেন, কিন্তু পরে ভিসা ইস্যু হতে দেরি হলে সমস্যা হয়। কাজেই যদি আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ ২ বছরের কম থাকে, তাহলে আগে রিনিউ করে নিন। পাসপোর্টে কোনো পাতা ছেঁড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত থাকলে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স এ সমস্যা হতে পারে।

পাসপোর্টের ফটোকপি অন্তত ১০ সেট করে রাখুন—বিএমইটি, মেডিকেল, এজেন্সি, দূতাবাস সবখানেই লাগবে। অনেকে পাসপোর্টে নামের বানান ভুল নিয়ে সমস্যায় পড়েন। আপনার এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন এবং পাসপোর্টে নামের বানান সম্পূর্ণ এক হতে হবে। একটু ভুল হলেও (যেমন Md. আর Md) পরে সংশোধনে সময় ও অর্থ নষ্ট হয়।

শিক্ষাগত সনদ এবং পেশাগত সার্টিফিকেটের প্রস্তুতি

আপনার সর্বশেষ শিক্ষাগত সনদের মূল কপি এবং সত্যায়িত ফটোকপি লাগবে। এসএসসি বা সমমানের সার্টিফিকেট হলে শিক্ষা বোর্ড থেকে সত্যায়ন করিয়ে নিন। যদি কোনো টেকনিক্যাল বা ভোকেশনাল কোর্স করে থাকেন (যেমন এনটিভিকিউএফ সার্টিফিকেট), সেটার মূল্য অনেক বেশি—এতে আপনার বেতন বেশি পাওয়ার সুযোগ থাকে।

অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ যদি আপনি দক্ষ পেশায় আবেদন করেন। পূর্ববর্তী চাকরিদাতার কাছ থেকে অফিশিয়াল লেটারহেড, সিল ও স্বাক্ষর সহ সার্টিফিকেট নিন। কাজের ধরন, সময়কাল (মাস/বছর) এবং আপনার দায়িত্ব স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। কর্মসংস্থান চুক্তি তৈরির সময় এই সার্টিফিকেট দেখে কোম্পানি আপনার যোগ্যতা যাচাই করবে।

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং অন্যান্য জরুরি কাগজপত্র

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বা “নো ক্রিমিনাল রেকর্ড” সার্টিফিকেট পেতে আপনার স্থানীয় থানায় আবেদন করতে হবে। সাধারণত ১৫-২০ দিন সময় লাগে এবং ফি প্রায় ৫০০-১০০০ টাকা। যদি আপনার বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলা বা জেলহাজতের রেকর্ড থাকে, তাহলে কলিং ভিসা পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। কাজেই সৎভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন।

নিয়োগ চুক্তিপত্র এবং চাহিদাপত্র যাচাই মালয়েশিয়ান কোম্পানি থেকে আসবে। এটা সাধারণত রিক্রুটিং এজেন্সি বা সরাসরি নিয়োগকর্তা পাঠায়। এই চুক্তিপত্রে কাজের ধরন, বেতন, থাকা-খাওয়া, কাজের সময়, চুক্তির মেয়াদ—সব স্পষ্ট লেখা থাকবে। সাইন করার আগে ভালো করে পড়ুন। অনেক সময় বাংলা অনুবাদ চেয়ে নিন যাতে পরে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়।

ছবি (পাসপোর্ট সাইজ) অন্তত ২০-৩০ কপি প্রিন্ট করে রাখুন—সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে সম্প্রতি তোলা ছবি হতে হবে। জন্ম নিবন্ধন সনদের সত্যায়িত কপি এবং বৈবাহিক সনদ (বিবাহিত হলে) লাগতে পারে।

ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ আবেদন প্রক্রিয়া: এখানেই ভুল করেন বেশিরভাগ মানুষ

১ম ধাপ: নিয়োগকর্তা যাচাই—সবচেয়ে বিপজ্জনক স্তর

আপনি নিজে বা কোনো এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির অফার পেয়েছেন। এখন নিয়োগকর্তা যাচাইকরণ অত্যন্ত জরুরি। প্রথমেই কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নম্বর (SSM নম্বর) চেয়ে নিন এবং মালয়েশিয়া কোম্পানি রেজিস্ট্রি (SSM অফিশিয়াল সাইট) থেকে ক্রস-চেক করুন। কোম্পানির নাম, ঠিকানা, ধরন—সব মিলিয়ে দেখুন।

অনেক প্রতারক গ্রুপ ভুয়া কোম্পানির নাম ব্যবহার করে। তারা আসল কোম্পানির নাম কিছুটা বদলে দেয় (যেমন “ABC Industries” এর বদলে “ABC Industry Sdn Bhd”)। আপনি ভুল কোম্পানিতে টাকা দিয়ে দেবেন কিন্তু ভিসা আসবে না। চাহিদাপত্রে কোম্পানির অফিশিয়াল লেটারহেড, সিল এবং অনুমোদনকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর আছে কিনা খেয়াল করুন। সম্ভব হলে সেই কর্মকর্তার নাম গুগল করে দেখুন—সত্যিই উনি সেই পদে আছেন কিনা।

২য় ধাপ: বিএমইটি অনুমোদন পাওয়ার কৌশল

চাহিদাপত্র হাতে পাওয়ার পর আপনার বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন প্রোফাইলে এটা আপলোড করতে হবে। বিএমইটি যাচাই করবে কোম্পানিটি তাদের অনুমোদিত তালিকায় আছে কিনা এবং ঐ কোম্পানির বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার অনুমতি আছে কিনা। এই পর্যায়ে বিএমইটি কখনো কখনো অতিরিক্ত তথ্য চাইতে পারে। যদি ১৫ দিনের মধ্যে কোনো রেসপন্স না পান, তাহলে হেল্পলাইনে কল করুন বা সরাসরি অফিসে যান।

বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স পেলে আপনাকে একটা “ক্লিয়ারেন্স কার্ড” বা অনুমোদন নম্বর দেবে। এটা পরবর্তী সব স্তরে লাগবে। এই কার্ডের ভ্যালিডিটি সাধারণত ৬ মাস। এর মধ্যে ভিসা প্রসেস সম্পন্ন না হলে রিনিউ করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিএমইটি শর্ত জুড়ে দিতে পারে—যেমন প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। এইসব শর্ত মেনে চলুন, না হলে শেষ মুহূর্তে আটকে যাবেন।

৩য় ধাপ: VDR আবেদন এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া

VDR অনুমোদন মানে হলো মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট আপনার ভিসার রেফারেন্স ইস্যু করেছে। এটা মূলত আপনার নিয়োগকর্তা মালয়েশিয়া থেকে আবেদন করবে। আপনার সব ডকুমেন্ট (পাসপোর্ট কপি, সনদপত্র, মেডিকেল রিপোর্ট) তারা ইমিগ্রেশন অফিসে জমা দেবে। ইমিগ্রেশন যাচাই করে ভিসা অ্যাপ্রুভ করবে এবং একটা রেফারেন্স নম্বর দেবে।

এই প্রক্রিয়ায় ১-২ মাস সময় লাগে। মাঝেমধ্যে কোম্পানির কোটা ফুরিয়ে গেলে বা অতিরিক্ত যাচাই প্রয়োজন হলে আরও দেরি হয়। VDR পাওয়ার পর বাংলাদেশে মালয়েশিয়া দূতাবাসে স্টিকার ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। এটার জন্য আবারও পাসপোর্ট, ছবি এবং VDR কপি লাগবে। দূতাবাসে যাওয়ার আগে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়—সরাসরি গিয়ে কোনো লাভ নেই।

৪র্থ ধাপ: মেডিকেল টেস্ট—ভিসা প্রত্যাখ্যানের বড় কারণ

মেডিকেল টেস্ট অবশ্যই বিএমইটি বা মালয়েশিয়া সরকার অনুমোদিত হাসপাতালে করাতে হবে। ঢাকায় কয়েকটা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল আছে যেখানে এই সেবা পাওয়া যায়—যেমন মহাখালী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, এবং আইসিডিডিআরবি। বেসরকারিতে ইউনাইটেড হসপিটাল, স্কয়ার হসপিটাল এবং আরো কয়েকটি অনুমোদিত।

পরীক্ষায় রক্ত (এইচআইভি, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস), প্রস্রাব (ড্রাগ টেস্ট), বুকের এক্স-রে (যক্ষ্মা ও ফুসফুসের সমস্যা), এবং সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা হয়। খরচ ৩০০০-৬০০০ টাকা হতে পারে হাসপাতাল ভেদে। রিপোর্ট পেতে ৩-৭ দিন সময় লাগে। যদি কোনো সমস্যা ধরা পড়ে (যেমন ডায়াবেটিস বেশি), তাহলে চিকিৎসা নিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার পর আবার টেস্ট দিতে হবে। ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই পরবর্তী ধাপে যেতে পারবেন।

৫ম ধাপ: ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও বায়োমেট্রিক—নিরাপত্তা যাচাই

মালয়েশিয়া সরকার এখন সব বিদেশি কর্মীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডাটাবেসে রাখে। বাংলাদেশে VFS Global বা মালয়েশিয়া ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে আপনার ১০ আঙুলের ছাপ এবং রেটিনা স্ক্যান নেওয়া হবে। এই বায়োমেট্রিক ডাটা সরাসরি মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয় এবং আপনার ভিসা প্রোফাইলের সাথে লিঙ্ক করা হয়। এটা করতে প্রায় ৩০ মিনিট লাগে এবং ফি ১৫০০-২৫০০ টাকা।

বায়োমেট্রিক দেওয়ার সময় নিশ্চিত করুন আপনার হাত পরিষ্কার এবং শুষ্ক আছে। আঙুলে কাটা, পোড়া বা ক্ষত থাকলে ঠিকমতো ছাপ নাও পড়তে পারে। পরে সমস্যা হতে পারে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী সময়মত যান—দেরি করলে আবার নতুন করে বুকিং করতে হয়।

৬ষ্ঠ ধাপ: ই-ভিসা পাওয়া এবং ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড

সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনার ই-ভিসা ইস্যু হবে। এটা ইমেইলে আসবে এবং আপনার পাসপোর্টে মালয়েশিয়া দূতাবাস একটা ভিসা স্টিকার লাগিয়ে দেবে। ভিসার মেয়াদ সাধারণত ৩-৬ মাস (সিঙ্গেল এন্ট্রি)। এই সময়ের মধ্যে আপনাকে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে হবে। দেরি করলে ভিসা এক্সপায়ার হয়ে যাবে এবং আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে।

পাশাপাশি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড বা “সবুজ কার্ড” পাবেন বিএমইটি থেকে। এটা বিমানবন্দরে চেক করা হয়—এই কার্ড ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বের হতে পারবেন না। কার্ডে আপনার ভিসার সব তথ্য, কোম্পানির নাম, চুক্তির মেয়াদ লেখা থাকবে। এটা হারিয়ে ফেললে বিশাল ঝামেলা—সযত্নে রাখবেন।

৭ম ধাপ: টিকেট বুকিং এবং প্রস্থানের প্রস্তুতি

ভিসা হাতে পেলে টিকেট বুক করুন। অনেক কোম্পানি টিকেট কিনে দেয় বা খরচ পরে বেতন থেকে কেটে নেয়। যদি নিজে কিনতে হয়, তাহলে ফ্লাইটের দাম ১৫-৩৫ হাজার টাকা হতে পারে সিজন ও এয়ারলাইন্স ভেদে। বাজেট এয়ারলাইন্স (এয়ারএশিয়া, মালিন্দো এয়ার) সস্তা কিন্তু লাগেজ ভাতা কম। ফুল-সার্ভিস এয়ারলাইন্স (মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ) তুলনামূলক আরামদায়ক।

টিকেট কনফার্ম হওয়ার পর নিয়োগকর্তাকে আপনার আগমনের তারিখ ও ফ্লাইট ডিটেইলস জানান। তারা বিমানবন্দরে কাউকে পাঠাবে আপনাকে রিসিভ করতে। প্রস্থানের আগে বিএমইটি থেকে প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং (PDO) নিন। এটা ১-২ দিনের কোর্স যেখানে মালয়েশিয়ার আইন-কানুন, সংস্কৃতি, করণীয়-বর্জনীয় শেখানো হয়। এই ট্রেনিং সার্টিফিকেট মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে দেখাতে হতে পারে।

খরচের সম্পূর্ণ হিসাব: কোথায় কত টাকা যাবে

সরকারি পদ্ধতিতে খরচ: ৭৮,৯৯০ থেকে ১,৬২,৫০০ টাকা

সরকারিভাবে সরকারি বনাম বেসরকারি এজেন্সি ব্যবহার না করে যেতে চাইলে খরচ অনেক কম হয়। বিএমইটি ফি ৫,০০০, পাসপোর্ট ফি ৩,৫০০-৫,০০০ (নতুন বা রিনিউ), মেডিকেল ৪,০০০-৬,০০০, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ৮০০, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ২,০০০, ভিসা ফি ১৮,০০০-২৫,০০০ (মালয়েশিয়া সরকারের), ট্রেনিং ৩,০০০, এবং টিকেট ২০,০০০-৩৫,০০০। মোট মিলিয়ে ৬০-৮০ হাজার টাকায় সম্ভব। তবে এটা শুধু তখনই হবে যখন আপনার সরাসরি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ আছে।

২০২৫ সালে সরকার একটি বিশেষ প্যাকেজ চালু করেছে যেখানে নির্দিষ্ট কিছু সরকারি-অনুমোদিত কোম্পানি ১,৬২,৫০০ টাকার মধ্যে সব খরচ (টিকেটসহ) কভার করবে। এই স্কিমে যেতে চাইলে বিএমইটির ওয়েবসাইটে “সরকারি খরচে মালয়েশিয়া” প্রোগ্রামে আবেদন করুন। তবে সিট সীমিত এবং প্রতিযোগিতা বেশি।

বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে: ৪-৬ লক্ষ টাকা

বেশিরভাগ মানুষ রিক্রুটিং এজেন্সি তালিকা থেকে অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে যান। এজেন্সিগুলো সব ব্যবস্থা করে দেয়—কোম্পানি খোঁজা, কাগজপত্র প্রসেসিং, টিকেট বুকিং। তবে এদের সার্ভিস চার্জ অনেক বেশি। সাধারণ ফ্যাক্টরি জবের জন্য ৩.৫-৪.৫ লক্ষ টাকা, দক্ষ পেশার জন্য ৫-৬ লক্ষ টাকা চার্জ করে।

এই টাকার মধ্যে সব খরচ (ভিসা, টিকেট, মেডিকেল) অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে কিছু এজেন্সি লুকানো খরচ রাখে—যেমন এয়ারপোর্ট সার্ভিস চার্জ ১৫,০০০, ডকুমেন্ট প্রসেসিং ১০,০০০—এমন নানা নামে আরও টাকা চায়। কাজেই চুক্তিতে সাইন করার আগে টোটাল খরচ স্পষ্টভাবে লিখিয়ে নিন। আংশিক টাকা ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার পর বাকিটা ভিসা পেলে দেবেন—এমন শর্ত রাখার চেষ্টা করুন।

কোম্পানি ও সেক্টর ভেদে খরচের তারতম্য

ফ্যাক্টরি ভিসা সাধারণত তুলনামূলক সস্তা কারণ এসব কোম্পানি বাল্ক হায়ারিং করে। ইলেকট্রনিক্স, গার্মেন্টস, খাদ্য প্রসেসিং সেক্টরে খরচ কম হয়। অন্যদিকে রেস্তোরাঁ, হোটেল বা কনস্ট্রাকশনে ব্যক্তিগত নিয়োগ বেশি, তাই খরচ বেশি। কোম্পানি ভিসা যেখানে কোম্পানি নিজেই সব খরচ বহন করে—এমন সুযোগ খুব কম এবং সাধারণত অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীদের জন্য হয়।

মনে রাখবেন, খরচ কম মানেই ভালো নয়। অনেক প্রতারক কম দামে ভিসার প্রলোভন দেখায় কিন্তু ফেক ডকুমেন্ট দিয়ে আটকে দেয়। আবার অতিরিক্ত চার্জও সন্দেহজনক। বাজার দর জেনে নিন এবং মাঝারি রেঞ্জের অনুমোদিত এজেন্সি বেছে নিন।

মেডিকেল টেস্ট: যেখানে অনেকের স্বপ্ন ভেঙে যায়

অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টার এবং খরচের বিস্তারিত

মালয়েশিয়া সরকার নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল অনুমোদন দিয়েছে যেখানে FOMEMA (Foreign Workers Medical Examination Monitoring Agency) রেজিস্টার্ড পরীক্ষা হয়। বাংলাদেশে এমন প্রায় ২০-২৫টি হাসপাতাল আছে। ঢাকায় প্রধান সেন্টারগুলো হলো: মহাখালী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (সরকারি, খরচ কম), ইউনাইটেড হসপিটাল (বেসরকারি, খরচ বেশি কিন্তু সেবা ভালো), স্কয়ার হসপিটাল, আইসিডিডিআরবি।

সরকারি হাসপাতালে খরচ ২৫০০-৪০০০ টাকা, বেসরকারিতে ৫০০০-৮০০০ টাকা। পরীক্ষার তালিকায় আছে: এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া (রক্ত পরীক্ষা), ড্রাগ স্ক্রিনিং (প্রস্রাব), বুকের এক্স-রে, উচ্চতা-ওজন-রক্তচাপ (সাধারণ ফিজিক্যাল)। সব মিলিয়ে রিপোর্ট পেতে ৩-৭ কার্যদিবস লাগে। জরুরি ভিত্তিতে ২৪-৪৮ ঘণ্টায়ও পাওয়া যায় অতিরিক্ত ফি দিয়ে।

সাধারণ সমস্যা এবং সমাধান

আমার এক প্রতিবেশী প্রথমবার মেডিকেল টেস্টে বুকের এক্স-রেতে একটা পুরনো যক্ষ্মার দাগ পাওয়া যায়। উনি ১০ বছর আগে যক্ষ্মা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন, কিন্তু দাগ রয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি পুরনো চিকিৎসার রেকর্ড এবং একটা ফ্রেশ স্পুটাম টেস্ট (নেগেটিভ) করিয়ে জমা দেন। এতে প্রমাণ হয় তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সংক্রামক নন। দ্বিতীয়বার ফিটনেস সার্টিফিকেট অ্যাপ্রুভ হয়।

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে প্রথমে নিয়ন্ত্রণে আনুন। টেস্টের আগে কয়েক সপ্তাহ ওষুধ খান এবং নিয়ম মেনে চলুন। ড্রাগ টেস্টের জন্য যেকোনো ধরনের মাদক (গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন) টেস্টের অন্তত ৩-৪ সপ্তাহ আগে থেকে বন্ধ করুন। নিকোটিন বা অ্যালকোহল সাধারণত সমস্যা করে না, তবে অতিরিক্ত পান না করাই ভালো।

অযোগ্য ঘোষিত হলে করণীয়

যদি মেডিকেল রিপোর্ট “Unfit” আসে, তাহলে প্রথমেই কারণটা জানুন। কিছু সমস্যা (যেমন এইচআইভি, সক্রিয় যক্ষ্মা, মানসিক রোগ) স্থায়ীভাবে অযোগ্য করে দেয়। কিন্তু কিছু সমস্যা সাময়িক—যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যানিমিয়া। এসব ক্ষেত্রে ৩-৬ মাস চিকিৎসা নিয়ে আবার টেস্ট দিতে পারবেন।

অনেক সময় ডাক্তারের ভুল বা মেশিনের ত্রুটিতে ভুল রিপোর্ট আসে। সেক্ষেত্রে অন্য একটা অনুমোদিত হাসপাতালে “সেকেন্ড অপিনিয়ন” নিন। যদি রিপোর্ট সঠিক হয় এবং সমস্যা গুরুতর, তাহলে দুঃখজনক হলেও মালয়েশিয়া ভিসার বদলে অন্য দেশ (সৌদি আরব, কাতার) বা অন্য পেশা ভাবুন।

চাকরির সেক্টর এবং বেতন: বাস্তব প্রত্যাশা রাখুন

উচ্চ চাহিদার সেক্টরগুলো

২০২৫ সালে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা এই সেক্টরগুলোতে: ইলেকট্রনিক্স ও সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাক্টরি (সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা, বেতন ভালো, কাজের পরিবেশ ভালো), পাম অয়েল প্ল্যান্টেশন ও মিল (কঠোর পরিশ্রম, তবে ওভারটাইম সুযোগ বেশি), নির্মাণ শিল্প (উঁচু ভবন, রাস্তা-সেতু নির্মাণ, দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বেশি), খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ (ফিশ প্রসেসিং, মাংস প্যাকেজিং, ফলমূল কারখানা), এবং রেস্তোরাঁ ও হোটেল (রান্না, পরিষেবা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী)।

আমার এক বন্ধু পেনাং-এর একটা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে কাজ করেন। তার মাসিক বেসিক বেতন ১৬০০ রিঙ্গিত, কিন্তু ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে ২২০০-২৪০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৫৫-৬০ হাজার টাকা) আয় হয়। কোম্পানি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়, তাই তিনি মাসে ১৮০০-২০০০ রিঙ্গিত (৪৫-৫০ হাজার টাকা) বাড়িতে পাঠাতে পারেন। এটাই মালয়েশিয়া কলিং ভিসার প্রকৃত সম্ভাবনা।

দক্ষ পেশার বিশেষ সুযোগ

ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, প্লাম্বার, মেশিন অপারেটর, টেইলর/গার্মেন্টস সুপারভাইজার—এসব দক্ষ পেশায় বেতন কাঠামো সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে ৩০-৫০% বেশি। একজন সার্টিফাইড ওয়েল্ডার ১৮০০-২২০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত পেতে পারেন। ইলেকট্রিশিয়ান (বিশেষত ইন্ডাস্ট্রিয়াল) ২০০০-২৫০০ রিঙ্গিতও পান। তবে এর জন্য আপনার সার্টিফিকেশন এবং প্রমাণিত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

মালয়েশিয়া সরকার “Skill Certification” প্রোগ্রাম চালু করেছে যেখানে দক্ষ শ্রমিকরা পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ-গ্রেডের সার্টিফিকেট পেতে পারেন। এতে বেতন বৃদ্ধি এবং ভিসা রিনিউয়াল সহজ হয়। যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করছেন, তাহলে যাওয়ার পর এই সার্টিফিকেশন নিয়ে নিন।

মাসিক বেতন এবং ওভারটাইমের হিসাব

২০২৫ সালে মালয়েশিয়ার সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ১৫০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৩৮,০০০ টাকা)। তবে বাস্তবে বেশিরভাগ কোম্পানি ১৫৫০-১৭০০ রিঙ্গিত দেয়। এর সাথে ওভারটাইম যোগ হয়—সাধারণ কর্মদিবসে ঘণ্টায় ১.৫ গুণ, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ২ গুণ, এবং সরকারি ছুটির দিনে ৩ গুণ হারে ওভারটাইম পাবেন।

যদি আপনার ঘণ্টা প্রতি রেট ১০ রিঙ্গিত হয়, তাহলে মাসে ৫০-৬০ ঘণ্টা ওভারটাইম করলে অতিরিক্ত ৫০০-৭০০ রিঙ্গিত আয় হবে। কিছু সেক্টরে (বিশেষত পাম অয়েল ও নির্মাণ) প্রায় ১০০+ ঘণ্টা ওভারটাইম সুযোগ আছে, তবে শারীরিক পরিশ্রম অনেক বেশি।

রেমিটেন্স এবং সঞ্চয়ের বাস্তব চিত্র

মালয়েশিয়া থেকে রেমিটেন্স পাঠানো অত্যন্ত সহজ এবং নিরাপদ। বিকাশ, নগদ, রকেটে সরাসরি টাকা পাঠাতে পারবেন। ব্যাংক ট্রান্সফারে (Western Union, MoneyGram, IME) ফি ১-২% এবং টাকা ২৪-৪৮ ঘণ্টায় পৌঁছায়। কিছু কোম্পানি সরাসরি বাংলাদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

থাকা-খাওয়া খরচ মাসে ৩০০-৫০০ রিঙ্গিত (কোম্পানি দিলে আরও কম)। ব্যক্তিগত খরচ (ফোন, যাতায়াত, বিনোদন) ২০০-৩০০ রিঙ্গিত। কাজেই মাসে ১০০০-১৫০০ রিঙ্গিত (২৫-৩৮ হাজার টাকা) সঞ্চয় করা বাস্তবসম্মত। দুই বছরে ভিসার খরচ তুলে ফেলতে পারবেন এবং তৃতীয় বছর থেকে পুরোটাই লাভ।

সরকারি বনাম বেসরকারি এজেন্সি: কাকে বিশ্বাস করবেন?

অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা যাচাই

বাংলাদেশে প্রায় ১০০০+ রিক্রুটিং এজেন্সি আছে, কিন্তু মালয়েশিয়া কলিং ভিসার জন্য অনুমোদিত মাত্র ২০০-২৫০টি। রিক্রুটিং এজেন্সি তালিকা BAIRA (Bangladesh Association of International Recruiting Agencies) এর ওয়েবসাইটে পাবেন। এছাড়া বিএমইটির সাইটেও অনুমোদিত এজেন্সির লিস্ট আছে। যেকোনো এজেন্সির সাথে কথা বলার আগে এই তালিকায় চেক করুন।

একটা এজেন্সি যাচাই করার পদ্ধতি: প্রথমে RL (Recruiting License) নম্বর চাইবেন এবং বিএমইটিতে ভেরিফাই করবেন। দ্বিতীয়ত, এজেন্সির ফিজিক্যাল অফিসে যান—শুধু ফোন নম্বর বা ফেসবুক পেজে বিশ্বাস করবেন না। তৃতীয়ত, পুরনো ক্লায়েন্টদের রেফারেন্স চান এবং তাদের সাথে কথা বলুন। চতুর্থত, চুক্তিপত্র ভালো করে পড়ুন এবং সম্ভব হলে কোনো আইনজীবীকে দেখান।

সরকারি প্রক্রিয়ার সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা

সরকারি পদ্ধতিতে (G2G – Government to Government) খরচ কম, প্রতারণার ঝুঁকি নেই এবং সব কিছু স্বচ্ছ। তবে সমস্যা হলো—আপনার নিজে কোম্পানি খুঁজতে হবে বা নির্দিষ্ট সরকারি প্রকল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রক্রিয়া ধীর—অনেক সময় ৬-৮ মাস লেগে যায়। সবার জন্য সিট নেই—সীমিত কোটায় লটারির মতো নির্বাচন হয়।

২০২৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে “সেফ মাইগ্রেশন” প্রোগ্রাম চালু করেছে যেখানে নির্বাচিত প্রার্থীদের সরকারিভাবে মালয়েশিয়া পাঠানো হচ্ছে। আবেদন করতে পারেন, কিন্তু পুরোপুরি এর উপর নির্ভর না করে বিকল্প পরিকল্পনাও রাখুন।

ছয় মাসের ঝক্কি শেষ! Jio, Vi ও BSNL-এর দুর্দান্ত রিচার্জ প্ল্যানগুলি জানুন

বেসরকারি এজেন্সি নির্বাচনের মানদণ্ড

একটা ভালো এজেন্সি চেনার উপায়: তাদের অন্তত ৫-১০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে কিনা। তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে বিশেষজ্ঞ (শুধু মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য) নাকি সব দেশে সব ধরনের ভিসা করে (সন্দেহজনক)। তাদের BAIRA সদস্যপদ আছে কিনা। তাদের সাফল্যের হার কেমন—প্রতি ১০০ জনে কতজন সফলভাবে ভিসা পেয়ে গেছেন।

এজেন্সির অফিস ঢাকার কোন এলাকায়—মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, বনানীর মতো প্রতিষ্ঠিত এলাকায় থাকলে ভালো। ছোট গলির মধ্যে টিনশেডে অফিস হলে সতর্ক থাকুন। স্টাফদের সাথে কথা বলে তাদের জ্ঞান যাচাই করুন—যদি তারা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে বা এড়িয়ে যায়, তাহলে বিপদ আছে।

লাইসেন্স ও BAIRA সদস্যপদের গুরুত্ব

BAIRA সদস্যপদ মানেই যে একেবারে নিরাপদ তা নয়, তবে একটা ভালো ইন্ডিকেটর। BAIRA-র নিজস্ব নিয়মকানুন এবং ডিসিপ্লিনারি কমিটি আছে। যদি কোনো সদস্য প্রতারণা করে, তাহলে BAIRA-তে অভিযোগ করতে পারবেন। তারা তদন্ত করে এবং প্রয়োজনে ঐ এজেন্সির সদস্যপদ বাতিল করে।

বৈধ শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করতে শুধু এজেন্সির লাইসেন্স নয়, মালয়েশিয়ান কোম্পানির লাইসেন্সও চেক করুন। কোম্পানির SSM রেজিস্ট্রেশন এবং মালয়েশিয়া সরকারের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে তাদের বিদেশি কর্মী নিয়োগের কোটা আছে কিনা—এসব যাচাই করা জরুরি।

অনলাইনে কলিং ভিসা যাচাইকরণ

মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের অফিশিয়াল পোর্টাল (imi.gov.my) এ গিয়ে আপনার VDR নম্বর দিয়ে চেক করতে পারবেন ভিসা সত্যি কিনা। বিএমইটির সাইটে আপনার রেজিস্ট্রেশন স্ট্যাটাস চেক করুন। মালয়েশিয়া দূতাবাস এর হেল্পলাইনে (ঢাকা অফিস) ফোন করে ভিসা নম্বর দিয়ে যাচাই করতে পারেন।

এছাড়া “আমি প্রবাসী” অ্যাপে আপনার সম্পূর্ণ প্রসেস ট্র্যাক করা যায়। প্রতিটা ধাপে নোটিফিকেশন আসবে। যদি দেখেন অ্যাপে কোনো আপডেট নেই কিন্তু এজেন্সি বলছে “সব ঠিক চলছে”, তাহলে সন্দেহ করুন।

প্রতারণার শিকার হলে আইনি পদক্ষেপ

যদি বুঝতে পারেন প্রতারণা হয়েছে, তাহলে প্রথমেই সব কাগজপত্র, রসিদ, চুক্তি, SMS, ইমেইল সংরক্ষণ করুন। এজেন্সির সাথে সব কথাবার্তা রেকর্ড করুন (আইনত অনুমোদিত)। তারপর এই পদক্ষেপগুলো নিন:

১) এজেন্সির বিরুদ্ধে বিএমইটিতে লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন।

২) BAIRA-তে অভিযোগ করুন (যদি সদস্য হয়)।

৩) স্থানীয় থানায় GD (জেনারেল ডায়েরি) করুন।

৪) প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করুন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইনেও অভিযোগ করতে পারেন। তারা মধ্যস্থতা করে এবং অনেক সময় টাকা ফেরত পাওয়া যায়। তবে সত্যি বলতে, আগাম সতর্কতাই সবচেয়ে ভালো প্রতিরক্ষা। প্রতারণা এড়ানোর উপায় হলো যাচাই-বাছাই করে, ধৈর্য ধরে, এবং লোভে পা না বাড়িয়ে কাজ করা।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন