পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর সামনে উঠে এল তীব্র প্রতিবাদের ঢেউ। এই ঘটনা শুধু আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি, বরং রাজনৈতিক মহলে তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রীকে নতুন করে আলোকপাত করেছে। প্রতিবাদের মুখে পড়লেও মমতা তাঁর দৃঢ়তা ও কৌশল দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, যা তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি লাভজনক মুহূর্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটে মার্চ ২০২৫-এর শেষ সপ্তাহে, যখন মমতা অক্সফোর্ড ইউনিয়নের আমন্ত্রণে একটি বক্তৃতা দিতে যান। এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে তিনি ভারতের গণতন্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হতেই একদল প্রতিবাদী তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে। তাদের অভিযোগ ছিল, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা, বিশেষ করে নারী নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে। এই প্রতিবাদের মুখে মমতা শান্ত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং তাঁর বক্তব্যে এই বিষয়গুলোর জবাব দেন। তাঁর এই দৃঢ়তা অনেকের কাছে প্রশংসার দাবি রাখে।
বিস্তারিত জানতে গেলে দেখা যায়, অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এই অনুষ্ঠানে মমতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভারতের একজন প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বাংলার উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নারীর ক্ষমতায়নের কথা তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পরেই একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছাত্র ও অধিকারকর্মী বলে পরিচয় দিয়েছে, প্রতিবাদ শুরু করে। তারা প্ল্যাকার্ড হাতে ‘জাস্টিস ফর বেঙ্গল’ এবং ‘স্টপ ভায়োলেন্স’ জাতীয় স্লোগান তুলে। তাদের দাবি ছিল, মমতার শাসনকালে বাংলায় নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে, যার মধ্যে গত বছরের একটি বড় ধর্ষণ কাণ্ডও রয়েছে। এই প্রতিবাদের ফলে অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মমতা তাঁর বক্তৃতায় এই অভিযোগের জবাব দেন। তিনি বলেন, “প্রতিবাদ গণতন্ত্রের অংশ, আমি এটাকে স্বাগত জানাই। তবে বাংলায় যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। আমরা নারীদের জন্য কাজ করছি, আরও অনেক কিছু করার আছে।” তিনি বাংলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সরকারের অর্জনের কথাও তুলে ধরেন। এই ঘটনার পর তিনি ব্রিটেনে বাঙালি সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি সভায়ও যোগ দেন, যেখানে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। এই দুই ঘটনা একসঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ দেয়।
এই ঘটনার প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তবে সমালোচকরা প্রায়ই তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ তোলেন। অক্সফোর্ডের প্রতিবাদে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা এই সমালোচনারই প্রতিধ্বনি। তবে মমতার সমর্থকরা বলছেন, এই প্রতিবাদ তাঁর জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি, বরং তাঁকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও বড় নেত্রী হিসেবে তুলে ধরেছে।
একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, অক্সফোর্ডের এই ঘটনা মমতার জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক হয়ে উঠেছে। ভারতে ফিরে তিনি এই প্রতিবাদকে ‘বিজেপি-সমর্থিত ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, বিরোধীরা তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করতে চায়। এই বক্তব্য তাঁর সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ জাগিয়েছে এবং বাংলার রাজনীতিতে তাঁর অবস্থানকে আরও মজবুত করেছে। তৃণমূলের নেতারা বলছেন, মমতা যেভাবে পরিস্থিতি সামলেছেন, তা তাঁর নেতৃত্বের শক্তি প্রমাণ করে।
অন্যদিকে, এই ঘটনা ভারতের বাইরে মমতার ইমেজ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এই প্রতিবাদের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি প্রতিফলন। তবে মমতার পক্ষে যারা আছেন, তারা এটাকে তাঁর সাহস ও দৃঢ়তার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। বাংলার বাইরে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সব মিলিয়ে, অক্সফোর্ডের এই ঘটনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি তা থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পেরেছেন। তাঁর বক্তব্য, দৃঢ়তা এবং পরবর্তী পদক্ষেপগুলো তাঁকে একজন শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। বাংলার রাজনীতিতে ‘দিদি’র এই জয় শুধু তাঁর দলের জন্য নয়, তাঁর ব্যক্তিগত ইমেজের জন্যও একটি বড় পাওয়া।