মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শীঘ্রই বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। এই সময়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে সরকার ও দলের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য তিনি আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন। সরকারের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছেন একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্সের হাতে। আর তৃণমূল কংগ্রেসের দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখভালের জন্য নির্ভর করেছেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। এই দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে মমতা যেন দলের অন্দরে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেলেন—প্রবীণ ও নবীন নেতৃত্বের সমন্বয়েই এগিয়ে যাবে তৃণমূল।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে গেলে দেখা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২২ মার্চ থেকে সাত দিনের জন্য যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। তিনি ফিরবেন ২৯ মার্চ রাতে। এই সফরের উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং অক্সফোর্ডে একটি বক্তৃতা দেওয়া। তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজ্যের প্রশাসনিক কাজ চলমান রাখতে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, যেখানে রয়েছেন মন্ত্রী ও আমলারা। অন্যদিকে, দলের কাজকর্মের দায়িত্ব তিনি সুব্রত বক্সি এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে তুলে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার নবান্নে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “দলের ব্যাপারটা সুব্রত বক্সি আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা মিলে দেখে নেবে। যদি কোনো পলিসি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।” এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দলের কর্মীদেরও আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি দূরে থাকলেও সবকিছুর ওপর নজর রাখবেন।
এই দায়িত্ব বণ্টনের পিছনে আরও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। তৃণমূলের অন্দরে দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণ এবং নবীন নেতাদের মধ্যে একটা অলিখিত দ্বন্দ্ব চলে আসছে। মমতা সাধারণত প্রবীণ নেতাদের ওপর বেশি ভরসা করেন বলে পরিচিত। অন্যদিকে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন প্রজন্মের নেতাদের সামনে এনে দলকে আরও গতিশীল করার চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্বভার যৌথভাবে দুজনের হাতে তুলে দিয়ে মমতা যেন একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইলেন। তিনি এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তাঁর অনুপস্থিতি সাময়িক এবং দলের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই থাকবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মমতা দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে একটা স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাসে এমন দায়িত্ব বণ্টন নতুন নয়। ১৯৯৮ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এর প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি একা হাতে দলকে পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকে ২০১৬ এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও দলের জয় অব্যাহত থেকেছে। এই দীর্ঘ পথচলায় প্রবীণ নেতারা যেমন দলের ভিত শক্ত করেছেন, তেমনই অভিষেকের মতো তরুণ নেতারা নতুন প্রজন্মের সমর্থন জোগাড় করেছেন। তবে, অভিষেককে অনেকে মমতার উত্তরসূরি হিসেবে দেখলেও, এবারের সিদ্ধান্তে তিনি এককভাবে দায়িত্ব না পাওয়ায় সেই জল্পনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, মমতার এই সিদ্ধান্ত দলের কর্মীদের কাছে একটা বড় বার্তা। তিনি চান না যে তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা বা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হোক। তাই তিনি সুব্রত বক্সি এবং অভিষেকের মতো দুই শক্তিশালী নেতার হাতে দায়িত্ব দিয়েছেন। সুব্রত বক্সি দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁর অভিজ্ঞতা দলের জন্য মূল্যবান। অন্যদিকে, অভিষেক তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় এবং দলের সাংগঠনিক কাজে দক্ষ। এই দুজনের সমন্বয়ে দলের কাজ এগিয়ে যাবে বলে মমতা আশাবাদী। তিনি এটাও বলে রেখেছেন যে, তাঁর ফোন সবসময় খোলা থাকবে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
বিষয়টির গভীরতা বোঝার জন্য আরেকটি দিক দেখা দরকার। তৃণমূলের অন্দরে গত কয়েক মাস ধরে নানা ঘটনা ঘটেছে, যা দলের ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেমন, কিছু প্রবীণ নেতা মনে করেন যে তরুণ নেতারা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন। আবার, অভিষেকের সমর্থকরা চান তিনি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এই পরিস্থিতিতে মমতার এই পদক্ষেপ যেন সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা দিচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে এই ঐক্য খুবই জরুরি। মমতা চান না যে তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতি দলের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াক।
শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চান না। তিনি বিদেশে থাকলেও দল ও সরকারের ওপর তাঁর প্রভাব অটুট থাকবে। সুব্রত বক্সি এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে দায়িত্ব দিয়ে তিনি প্রবীণ ও নবীনের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করেছেন। এই সমন্বয় দলকে আরও শক্তিশালী করবে নাকি নতুন কোনো সমীকরণের জন্ম দেবে, তা সময়ই বলবে। তবে, মমতার এই কৌশল তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।