উচ্চ রক্তচাপ, যা হাইপারটেনশন নামেও পরিচিত, একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে এর প্রকোপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
উচ্চ রক্তচাপ হলো একটি অবস্থা যেখানে রক্তবাহী শিরাগুলোতে রক্তের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত, 120/80 mmHg এর বেশি রক্তচাপকে উচ্চ বলে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় 1.28 বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক (30-79 বছর বয়সী) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
উচ্চ রক্তচাপের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (NCDC) এর সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের প্রায় 21% প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে এই হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি (শহরে 23%, গ্রামে 18%)।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপের একটি প্রধান কারণ। এক পুষ্টি সমীক্ষা অনুযায়ী,দেশের জনগণ প্রতিদিন গড়ে 11 গ্রাম লবণ গ্রহণ করে, যা WHO’র সুপারিশকৃত 5 গ্রামের দ্বিগুণেরও বেশি।
অস্বাস্থ্যকর খাবার ও ফাস্ট ফুডের ব্যাপক প্রচলন আরেকটি উদ্বেগের কারণ। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (NIPORT) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে প্রায় 35% মানুষ নিয়মিত ফাস্ট ফুড খান, যা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
অপর্যাপ্ত পানি পানও উচ্চ রক্তচাপের একটি কারণ হতে পারে। জাতীয় পুষ্টি সেবা (NNS) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় 40% প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ (8 গ্লাস বা তার বেশি) পানি পান করেন না।
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা উচ্চ রক্তচাপের আরেকটি প্রধান কারণ। জাতীয় অসংক্রামক রোগ জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় 27% প্রাপ্তবয়স্ক পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন না।
ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় 35% পুরুষ ও 1% নারী ধূমপান করেন।
অনিয়মিত ঘুম ও অতিরিক্ত কাজের চাপও উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। শ্রম শক্তি জরিপ অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে কর্মজীবী মানুষের প্রায় 40% প্রতিদিন 10 ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, যা তাদের ঘুমের সময় কমিয়ে দেয়।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ উচ্চ রক্তচাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের প্রায় 16.8% প্রাপ্তবয়স্ক কোনো না কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
উদ্বেগ ও বিষণ্নতাও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় 6.7% মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একটি বড় বাধা। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র 30% প্রাপ্তবয়স্ক নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
ঔষধ সেবনে অনিয়মিততাও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে। জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশন হাসপাতালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় 40% নিয়মিত ঔষধ সেবন করেন না।
সহ-রোগের প্রভাব, বিশেষত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি (BADAS) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় 8.4 মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি।
শহুরে জীবনের চাপ উচ্চ রক্তচাপের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় 37%, যাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার বেশি।
বায়ু দূষণের প্রভাবও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলকাতা শহরে বায়ুর গুণগত মান WHO‘র নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় 5 গুণ খারাপ, যা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
শব্দ দূষণও উচ্চ রক্তচাপের একটি কারণ হতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, শহর এলাকায় সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য শব্দের মাত্রা 60 ডেসিবেল, কিন্তু বাস্তবে এটি প্রায়শই 80-90 ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা যার পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কারণ। এর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা, সামাজিক সহযোগিতা এবং সরকারি নীতিমালার সমন্বিত প্রয়োগ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সাহায্যে উচ্চ রক্তচাপের কারণ, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এধরনের প্রচারণার ফলে গত বছর প্রায় 15% মানুষ তাদের রক্তচাপ পরীক্ষা করিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা। এর ফলে নতুন প্রজন্ম স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠবে।
বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি পাইলট প্রজেক্টে দেখা গেছে, এধরনের কার্যক্রমের ফলে কর্মীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার প্রায় 10% কমেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে স্বাস্থ্যকর খাবার ও কম লবণযুক্ত খাবারের প্রচার। জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহে এধরনের প্রচারণার ফলে গত বছর প্রায় 20% মানুষ তাদের দৈনিক লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়েছেন।
শহর এলাকায় হাঁটার পথ, সাইকেল লেন ও পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে মানুষকে শারীরিক কার্যকলাপে উৎসাহিত করা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে দেখা গেছে, এধরনের পদক্ষেপের ফলে শহরবাসীর মধ্যে নিয়মিত ব্যায়ামের হার প্রায় 25% বেড়েছে।
ধূমপানের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর প্রয়োগের ফলে ধূমপানের হার প্রায় 5% কমেছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। গত বছর ঢাকা শহরে গাড়ির হর্ন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে শব্দ দূষণের মাত্রা প্রায় 15% কমেছে।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ চালু করা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়ানো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা প্রায় 20% বেড়েছে।
উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত গবেষণায় সরকারি অনুদান বৃদ্ধি। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক গবেষণায় সরকারি অনুদান 30% বৃদ্ধি পেয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পাইলট প্রজেক্টে দেখা গেছে, এধরনের পদক্ষেপের ফলে গ্রামাঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণের হার প্রায় 40% বেড়েছে।
উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ কমানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকার, বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সফলতা অর্জন করতে পারলে তা দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মন্তব্য করুন