বছরের শেষ পূর্ণিমা মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ২০২৫ সাল পড়ছে ৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। এই পবিত্র তিথি শুরু হবে ৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৩৭ মিনিটে এবং শেষ হবে ৫ ডিসেম্বর ভোর ৪টা ৪৩ মিনিটে। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, “মাসানাং মার্গশীর্ষোহম” অর্থাৎ সমস্ত মাসের মধ্যে আমি মার্গশীর্ষ। এই কারণেই এই মাসের পূর্ণিমা অত্যন্ত পবিত্র ও ফলদায়ক বলে বিবেচিত হয়।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ২০২৫: তিথি ও সময়সূচী
২০২৫ সালের শেষ পূর্ণিমা তিথি নির্ভুল সময়ের সাথে উদযাপিত করা অত্যন্ত জরুরি। পঞ্চাং অনুসারে এই বছর মার্গশীর্ষ পূর্ণিমার বিস্তারিত সময়সূচী নিম্নরূপ:
| বিবরণ | তারিখ ও সময় |
|---|---|
| পূর্ণিমা তিথি | ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) |
| তিথি শুরু | ৪ ডিসেম্বর সকাল ৮:৩৭ মিনিট |
| তিথি সমাপ্তি | ৫ ডিসেম্বর ভোর ৪:৪৩ মিনিট |
| চন্দ্রোদয় | বিকেল ৪:৩৫ মিনিট |
| ব্রহ্ম মুহূর্ত | ভোর ৪:১৯ মিনিট (৩৯ মিনিট স্থায়ী) |
হিন্দু শাস্ত্রে উদয়তিথির নিয়ম অনুসারে যেদিন সূর্যোদয়ের সময় তিথি থাকে সেদিনই ব্রত, পূজা ও দান করতে হয়। তাই এবার সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ৪ ডিসেম্বরই সম্পন্ন করতে হবে।
মার্গশীর্ষ পূর্ণিমার ধর্মীয় মাহাত্ম্য
অগ্রহায়ণ মাস হিন্দু ধর্মে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় মাস। ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন যে সমস্ত মাসের মধ্যে তিনি মার্গশীর্ষ মাস। এই উক্তি থেকেই বোঝা যায় এই মাসের পবিত্রতা কতটা গভীর।
এই পূর্ণিমা তিথিতে পবিত্র নদীতে স্নান, ভগবান বিষ্ণুর পূজা, সত্যনারায়ণ ব্রত পালন ও দান করার অসাধারণ ফল পাওয়া যায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে এই দিনে চন্দ্রদেব তার ১৬টি কলা সহ উজ্জ্বল হন এবং তাঁর পবিত্র শক্তি জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ইতিবাচকতা নিয়ে আসে।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় কোন কোন দেবতার পূজা করবেন
মার্গশীর্ষ পূর্ণিমা তিথিতে একাধিক দেবদেবীর আরাধনা করার বিধান রয়েছে। প্রতিটি দেবতার পূজার নিজস্ব তাৎপর্য ও ফলাফল রয়েছে:
ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মী: এই তিথিতে ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর পূজা করলে ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি ও সুখ-শান্তি লাভ হয়। বিষ্ণুসহস্রনাম পাঠ এই দিনে বিশেষ ফলদায়ক।
ভগবান সত্যনারায়ণ: সত্যনারায়ণ ব্রত পালন ও কথা শ্রবণ এই পূর্ণিমায় অত্যন্ত পুণ্যদায়ক। এই পূজা পরিবারে সুখ, সমৃদ্ধি ও মঙ্গল বৃদ্ধি করে। পঞ্চামৃত (দুধ, দই, ঘি, মধু ও চিনির মিশ্রণ) নিবেদন করা এই পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
চন্দ্রদেব: চন্দ্র পূজা করলে মানসিক শান্তি ও জ্যোতিষশাস্ত্রীয় চন্দ্রদোষ নিবারণ হয়। চাঁদকে অর্ঘ্য দেওয়া এই দিনের একটি প্রধান রীতি।
সত্যনারায়ণ পূজার বিধি ও উপকরণ
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পূজা অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ। এই পূজা সকাল অথবা সন্ধ্যায় করা যায়। পূজার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি হল:
-
গোটা চাল, কর্পূর, ধূপ ও প্রদীপ
-
ঘট, নারকেল, আমের পাতা
-
মৌসুমি ফল, মিষ্টি ও নৈবেদ্য
-
সাদা ও হলুদ ফুল
-
ভগবান সত্যনারায়ণের মূর্তি বা ছবি
-
ধুতি, গামছা, পৈতে ও বস্ত্র
-
পান, সুপারি, গঙ্গাজল
-
দেশি ঘি, মধু, চিনি
-
যজ্ঞের সামগ্রী ও কাঠ
পূজার পদ্ধতি অনুসারে প্রথমে গণেশ ও নবগ্রহের পূজা করতে হয়। তারপর ভগবান সত্যনারায়ণের ধ্যান করে জল, পঞ্চামৃত, ফুল, ফল, ধূপ, দীপ নিবেদন করতে হয়। এরপর সত্যনারায়ণ ব্রতকথা পাঠ করা হয় এবং শেষে আরতি ও প্রসাদ বিতরণ করতে হয়।
স্নান ও দানের মাহাত্ম্য
মার্গশীর্ষ পূর্ণিমায় পবিত্র নদীতে স্নান করার অসীম পুণ্য রয়েছে। গঙ্গা, যমুনা বা অন্য পবিত্র নদীতে স্নান করতে না পারলে গৃহেই গঙ্গাজল মিশিয়ে স্নান করা যায়। ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।
এই তিথিতে দানের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। তিল, গুড়, ঘি, কম্বল, খাদ্যসামগ্রী বা অর্থ দান করা অত্যন্ত শুভফলদায়ক। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে এই দিনে দান করলে তার ফল বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র ও ব্রাহ্মণদের খাদ্য ও বস্ত্র দান করলে মা লক্ষ্মীর কৃপা লাভ হয়।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ব্রত পালনের নিয়ম
পূর্ণিমার ব্রত পালন অত্যন্ত পুণ্যদায়ক। এই ব্রত পালনের বিস্তারিত নিয়ম হল:
প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠান: ব্রহ্ম মুহূর্তে উঠে স্নান করতে হবে। পবিত্র নদীতে তর্পণ করার বিধান রয়েছে। স্নানের পর ব্রত পালনের সংকল্প নিতে হয়।
পূজা পদ্ধতি: প্রথমে গণেশ পূজা করতে হয়, তারপর কলস পূজা। এরপর ভগবান বিষ্ণু ও সত্যনারায়ণের পূজা করা হয়। ধূপ, দীপ, ফুল, ফল, নৈবেদ্য অর্পণ করতে হয়।
উপবাস: সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যায় চন্দ্রদর্শনের পর অর্ঘ্য দিয়ে ব্রত খোলা যায়। যারা নিরাহার থাকতে পারেন না তারা ফলাহার করতে পারেন।
সন্ধ্যাকালীন অনুষ্ঠান: চন্দ্রোদয়ের পর চন্দ্রদেবকে জল, দুধ, ফুল ও চন্দন দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করতে হয়। আরতি করে প্রসাদ বিতরণ করতে হয়।
মার্গশীর্ষ মাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তিথি
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ছাড়াও এই মাসে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তিথি রয়েছে:
উৎপন্না একাদশী: এটি বছরের প্রথম একাদশী যেখানে ভগবান বিষ্ণুর উপবাস শুরু হয়। এই তিথি অত্যন্ত পবিত্র ও ফলপ্রদ।
বিবাহ পঞ্চমী: এই তিথিতে ভগবান রাম ও মা সীতার দিব্য বিবাহ উদযাপিত হয়। মন্দিরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
গীতা জয়ন্তী: এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। এটি দিব্য জ্ঞান ও আত্ম-উপলব্ধির দিন।
মোক্ষদা একাদশী: মুক্তির একাদশী হিসেবে পরিচিত এই তিথিতে পূর্বপুরুষদের মুক্তি ও অন্তরাত্মার শান্তি লাভ হয়।
দত্তাত্রেয় জয়ন্তী: ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের সম্মিলিত অবতার ভগবান দত্তাত্রেয়ের জন্মদিন।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় রবি যোগের বিশেষত্ব
২০২৫ সালের অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় একটি বিশেষ জ্যোতিষীয় যোগ তৈরি হচ্ছে – রবি যোগ। এই যোগ তিথিকে আরও মাহাত্ম্যপূর্ণ করে তোলে। রবি যোগের সময় যেকোনো শুভ কাজ, পূজা, দান ও ব্রত পালনের ফল বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে রবি যোগে পূর্ণিমা তিথি পড়া খুবই দুর্লভ। এই সময়ে সূর্য ও চন্দ্রের শুভ শক্তি একসাথে কাজ করে। তাই এই দিনে ধর্মীয় কাজ করলে জীবনে সমৃদ্ধি, সুখ ও মানসিক শান্তি আসে।
পূর্ণিমা তিথির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
হিন্দু ধর্মে পূর্ণিমা তিথির বিশেষ স্থান রয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও মানসিক ভারসাম্য বৃদ্ধির প্রতীক। পূর্ণিমার দিনে চন্দ্রের সকল ১৬টি কলা পূর্ণ হয় এবং তার দিব্য শক্তি জীবনে শান্তি ও ইতিবাচকতা নিয়ে আসে।
বিশেষত মার্গশীর্ষ মাসের পূর্ণিমায় চন্দ্রের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়। এই সময়ে মেডিটেশন, ধ্যান ও আধ্যাত্মিক সাধনা করলে মন শুদ্ধ হয় এবং আত্মিক উন্নতি ঘটে। যোগ ও প্রাণায়াম অনুশীলন এই দিনে বিশেষ ফলপ্রদ।
বছরের শেষ পূর্ণিমার বিশেষত্ব
২০২৫ সালের শেষ পূর্ণিমা হিসেবে মার্গশীর্ষ পূর্ণিমা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বছর শেষ হওয়ার আগে এই পূর্ণিমায় পূজা, ব্রত ও দান করলে আগামী বছরের জন্য শুভফল লাভ হয়। এই দিনে করা প্রার্থনা ও সংকল্প নতুন বছরে পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে বছরের শেষ পূর্ণিমায় পাপ মোচন ও পুণ্য অর্জনের বিশেষ সুযোগ থাকে। এই তিথিতে পূর্ববর্তী বছরের সমস্ত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ও নতুন সংকল্প নেওয়া উচিত।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় কী কী এড়িয়ে চলবেন
পূর্ণিমার দিনে কিছু কাজ এড়িয়ে চলা উচিত যা শুভ ফল নষ্ট করতে পারে:
-
মাংস, মাছ, পেঁয়াজ, রসুন জাতীয় তামসিক খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
-
রাগ, ক্রোধ, হিংসা ও নেগেটিভ চিন্তা পরিহার করুন
-
অসত্য কথা বলা ও কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন
-
অপবিত্র অবস্থায় পূজা করবেন না
-
সূর্যাস্তের পর তেল, লবণ ও কাঁচা খাবার খাবেন না
-
দিনের বেলা ঘুমানো এড়িয়ে চলুন
এই নিয়মগুলি মেনে চললে ব্রত পালনের সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায়।
মার্গশীর্ষ পূর্ণিমার উপকারিতা
শাস্ত্র অনুসারে এই পবিত্র তিথিতে ব্রত পালন ও পূজা করলে অসংখ্য উপকার পাওয়া যায়:
-
পাপ মোচন ও পুণ্য অর্জন
-
মানসিক শান্তি ও আত্মিক উন্নতি
-
সংসারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি
-
ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর কৃপা লাভ
-
চন্দ্রদোষ নিবারণ ও গ্রহশান্তি
-
ইচ্ছা পূরণ ও মনোকামনা সিদ্ধি
-
আর্থিক উন্নতি ও ব্যবসায় সাফল্য
-
পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হওয়া
-
রোগমুক্তি ও স্বাস্থ্য লাভ
নিয়মিত পূর্ণিমার ব্রত পালন করলে জীবনে স্থিরতা ও সাফল্য আসে। বিশেষত মার্গশীর্ষ পূর্ণিমার ব্রত অত্যন্ত ফলদায়ক।
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ২০২৫ শুধুমাত্র বছরের শেষ পূর্ণিমা নয়, এটি একটি অত্যন্ত পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ তিথি যা আধ্যাত্মিক উন্নতি ও জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ করে দেয়। ৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এই বিশেষ তিথিতে ভগবান বিষ্ণু, মা লক্ষ্মী ও চন্দ্রদেবের পূজা, সত্যনারায়ণ ব্রত পালন, পবিত্র স্নান ও দান করে আপনি দিব্য আশীর্বাদ লাভ করতে পারেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস মার্গশীর্ষে এই পূর্ণিমা পালন করলে জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুখের বৃদ্ধি হয়। রবি যোগের সাথে এই পূর্ণিমা আরও বিশেষ হয়ে উঠেছে, তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে এই ব্রত পালন করুন এবং জীবনে দিব্য আলোর আশীর্বাদ গ্রহণ করুন।











