ভারতের অপারেশন সিঁদুর হামলায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারের ১৪ জন পরিবারের সদস্য নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার ১৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ঘোষণা করেছেন, ভারতের হামলায় নিহত প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ-ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহার নিজেকে একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তার হাতে এই বিপুল অর্থ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপারেশন সিঁদুর: ভারতের সামরিক অভিযান
৭ মে, ২০২৫-এ ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি সন্ত্রাসবাদী ঠিকানায় সুনির্দিষ্ট হামলা চালায়, যা “অপারেশন সিঁদুর” নামে পরিচিত। এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল জইশ-ই-মহম্মদের বাহাওয়ালপুর সদর দপ্তর এবং লশকর-ই-তৈবার মুরিদকে অবস্থিত ঘাঁটি। ভারতীয় সামরিক সূত্র অনুযায়ী, এই হামলায় ১০০-রও বেশি সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়েছে।
হামলার মধ্যরাতে ভাওয়ালপুরে জইশের সদর দপ্তর জামিয়া মসজিদ সুভান আল্লায় বা উসমান-ও-আলি ক্যাম্পাসে ভারতীয় বায়ুসেনা হামলা চালায়। মাসুদ আজহারের নিজের বক্তব্য অনুসারে, হামলায় তার পরিবারের ১০ জন সদস্য এবং ৪ জন নিকট সহযোগী নিহত হয়েছে, যদিও অনিশ্চিত সূত্রে দাবি করা হয়েছে যে ১৪ জন তার পরিবারের সদস্য মারা গেছেন।
নিহতদের পরিচয় ও পাকিস্তানের ক্ষতিপূরণ নীতি
নিহতদের মধ্যে মাসুদ আজহারের বড় বোন ও তার স্বামী, একজন ভাগনে ও তার স্ত্রী, একজন ভাইঝি এবং পরিবারের পাঁচ শিশু রয়েছে। পাকিস্তানি মিডিয়া সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, এই সকল নিহত ব্যক্তিদের জানাজা বাহাওয়ালপুরে অনুষ্ঠিত হবে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান (এপিপি) জানিয়েছে যে, পাকিস্তান সরকার প্রতিটি নিহত ব্যক্তির জন্য ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। এই অর্থ আইনি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ করা হবে। যদি মাসুদ আজহার প্রমাণ করতে পারে যে তিনি নিহতদের একমাত্র আইনি উত্তরাধিকারী, তাহলে তিনি পুরো ১৪ কোটি টাকা পেতে পারেন।
এছাড়াও, পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ভারতীয় হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর পুনর্নির্মাণেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সমালোচনার মুখে পড়েছে, কারণ তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে পুনর্নির্মিত কাঠামোগুলি আবার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
মাসুদ আজহারের পটভূমি
মাসুদ আজহার জাতিসংঘ-ঘোষিত একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী, যাকে ১ মে, ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তিনি জইশ-ই-মহম্মদ নামক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, যা পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) দ্বারা ২০০০ সালে সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাসুদ আজহার ভারতে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা। ১৯৯৯ সালে একটি ভারতীয় বিমানের অপহরণের পর তিনহুত তিনজন সন্ত্রাসবাদীকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ভারত তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
অপারেশন সিঁদুরের প্রভাব ও পাকিস্তানের ক্ষতি
অপারেশন সিঁদুর পাকিস্তানের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে যে, এই অভিযানে ১১ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মী নিহত হয়েছে এবং ৭৮ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার উসমান ইউসুফ, চীফ টেকনিশিয়ান আওরঙ্গজেব, সিনিয়র টেকনিশিয়ান নাজিব, কর্পোরাল টেকনিশিয়ান ফারুক এবং সিনিয়র টেকনিশিয়ান মুবাশির রয়েছেন।
ফার্স্টপোস্ট অনুসারে, অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর সম্পদের ২০% ধ্বংস হয়েছে এবং ৫০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী নুর খান এয়ারবেস, সুক্কুর বেস, রহিম ইয়ার খান, সরগোধা’র মুশাফ এয়ারবেস, শাহবাজ জ্যাকোবাবাদ এবং ভোলারি সহ বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছিল।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ও তার পরিণতি
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর, শনিবার (১০ মে) যুদ্ধবিরতির একটি বোঝাপড়া হয়েছিল। তবে, পাকিস্তান এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে উভয় দেশের সামরিক অপারেশনের মহাপরিচালকদের (ডিজিএমও) মধ্যে আলোচনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। এরপর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার সামরিক প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পাকিস্তানের সামরিক ও বিমান পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সতর্ক করেছেন যে, ভারত আগামী দিনগুলোতে পাকিস্তানের কার্যকলাপ সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, যদি আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে ভারত শক্তভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং সন্ত্রাসীদের বাড়িতে ঢুকে তাদের পালানোর সুযোগও দেবে না। তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সন্ত্রাসীরা বসে শান্তিতে শ্বাস নিতে পারে।”
পাকিস্তানের ক্ষতিপূরণ নীতির সমালোচনা
ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা পাকিস্তানের ক্ষতিপূরণ নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ভারত সবসময় দাবি করে আসছে যে, তাদের হামলা কেবল সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করেছিল এবং বেসামরিক এলাকা আক্রান্ত হয়নি।
ভারতীয় সূত্র অনুসারে, ৭ মে রাতে অপারেশন সিঁদুর এমন একটি সুনির্দিষ্ট অভিযান ছিল যা কেবল সন্ত্রাস দমনে কেন্দ্রিভূত ছিল। তারা বলেছে, “আমরা ওদের সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো ধ্বংস করেছি, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আঘাত হেনেছি এবং তাদের বেশ কয়েকটি বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্য করেছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর শেষ চার দিনের অভিযান খুব সফল ছিল। পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণ অধিকাংশই ব্যর্থ করা হয়েছে।”
পাকিস্তানের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর গোলাবর্ষণের কারণে ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে, যার মধ্যে ৭ জন মহিলা ও ১৫ শিশু রয়েছে। তারা আরও দাবি করেছে যে, ১২১ জন আহত হয়েছে, যার মধ্যে ২৭ শিশু ও ১০ মহিলা রয়েছে। তবে, ভারত সবসময় জোর দিয়ে বলেছে যে, তাদের সামরিক বাহিনী বেসামরিক হতাহত এড়াতে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা পর্যবেক্ষণ করছে এবং যুদ্ধবিরতির প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব সমস্ত পক্ষকে সংযম প্রদর্শন করতে এবং কূটনৈতিক মাধ্যমে বিরোধের সমাধান করতে আহ্বান জানিয়েছেন।
মাসুদ আজহারকে ১৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত বিতর্কিত। একদিকে যেখানে পাকিস্তান সরকার এটিকে নিছক একটি মানবিক উদ্যোগ হিসেবে উপস্থাপন করছে, সেখানে অন্যদিকে ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একাংশ এটিকে সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের গোপন মদতের আরেকটি প্রমাণ হিসেবে দেখছে।
অপারেশন সিঁদুর প্রমাণ করেছে যে, ভারত তার সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী হুমকি মোকাবেলায় দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এই অভিযানের সাফল্য ভারতের সামরিক সক্ষমতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছে, এবং এটি ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থানের একটি স্পষ্ট বার্তা। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।