Matiari village of Nadia District: এক সময় নদীয়া জেলা একটি সুবিস্তীর্ণ জনপদ ছিল। এই জেলাটি ১৭৮৬ সালে সৃষ্টি হয়েছিল। যখন দেশ ভাগ হয়েছিল তখন নদীয়া জেলাও ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত নদীয়া পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যার ফলে ভীষণ সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য স্যার সিরি রাডক্লিফের উপর দায়িত্ব বর্তায় ।
তাঁর রায় অনুসারে ১৮ ই আগস্ট নদীয়া জেলার তিনটি মহকুমা ( কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা ) পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়, নাম হয় কুষ্টিয়া জেলা এবং বাকি দুটি মহকুমা ( কৃষ্ণনগর ও রাণাঘাট ) নিয়ে প্রথমে নবদ্বীপ, পরে নদীয়া জেলা নাম নিয়ে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৫১ সালে দিল্লি থেকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত “History of Indian Railway “ পুস্তক থেকে জানা যায়, নদীয়াতে রেল চলাচল প্রথম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর শিয়ালদহ থেকে নদীয়ার কুষ্টিয়া পর্যন্ত। হান্টার সাহেব তাঁর বিবরণীতে লিখেছেন যে, ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপিত হবার পরও রেল স্টেশন ব্যাবসা বাণিজ্যের খুব বড় কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে নি। নদীর ধারেই তখন ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র গুলি ছিল, কারণ নৌপরিবহন তখনও গুরুত্ব হারায় নি।
মাটিয়ারি গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত থাকলেও, গ্রামটি উঁচু মাটির ঢিবি বা স্তুপ আকারে দাঁড়িয়ে আছে বলেই এর মাটিয়ারি নাম বলে অনেকে মনে করেন।বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার অন্তর্গত এই মাটিয়ারি গ্রাম।
নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাগোয়ান (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত) গ্রাম থেকে তাঁর রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করেন। আদিশূর কর্তৃক পঞ্চব্রাহ্মণের অন্যতম ভট্টনারায়নের অধস্তন কুড়িতম পুরুষ ভবানন্দ। তাঁর পূর্বনাম ছিল দুর্গাদাস সমাদ্দার। তিনি এক সময়ে যশোহর রাজ প্রতাপাদিত্যের অধীনে কর্মচারী ছিলেন এবং হুগলীর কানুনগো রূপে কাজ করেছিলেন। প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে সাহায্য করায় মোগল সেনাপতি মানসিংহ ভবানন্দের প্রতি অতিশয় তুষ্ট হন এবং মানসিংহের সুপারিশ ক্রমেই জাহাঙ্গীর ১০১৫ হিজরীতে (১৬০৬ খ্রীঃ ) তাঁকে নদীয়া, মহৎপুর, লেপা, সুলতান পুর প্রভৃতি ১৪ টি পরগনার জমিদারি ফরমান ও সম্মানসূচক ‘ মজুমদার ‘ উপাধি দানে সম্মানিত করেন।
এইভাবে বিরাট ভূসম্পত্তি ও রাজ সম্মানের অধিকারী হয়ে ভবানন্দ মাটিয়ারি গ্রামে পরিখা বেষ্টিত এক রাজবাড়ি ও গড় নির্মাণ করেন। ১৬৯৫ খ্রীঃ মেদিনীপুর জেলার চেতুয়া – বরদা গরগণার রাজা শোভা সিংহের আক্রমণে বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরামের মৃত্যু হলে , তাঁর পুত্র জগৎরাম ভবানন্দের পঞ্চম পুরুষ নদীয়া রাজ রামকৃষ্ণের সুরক্ষিত মাটিয়ারি রাজপ্রাসাদে আশ্রয় পান। বর্তমানে এই রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে। এক সুবিস্তৃত উচ্চভূমির উপরে রাজ বাড়িটি অবস্থিত ছিল। পূর্বতন প্রাসাদ এলাকার অনেকখানি জুড়ে এখন চাষাবাদ হয়।
নদীয়া জেলায় কাঁসা ও পিতল শিল্প একটি সমৃদ্ধশালী শিল্প ছিল। বিজয়রাম বিশারদের ‘তীর্থমঙ্গল ‘(১৭৭০ খ্রীঃ ) কাব্যের বর্ণনায় নবদ্বীপের কাঁসা শিল্পের উল্লেখ আছে। এছাড়া নবদ্বীপে কাঁসারিপাড়া নামে একটি পল্লীও বর্তমান আছে। কিন্তু এই শিল্পে আজকাল ভাঁটা পড়েছে। কেননা আজকাল বিভিন্ন ধরনের অ্যালুমিনিয়াম , স্টেনলেস স্টীল ও প্লাস্টিকের বাসনপত্রের সঙ্গে কাঁসা পিতলের বাসন এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দাঁড়িয়ে নদীয়া জেলায় মাটিয়ারি গ্রাম মোটামুটি গৌরবের সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটাই ছিল এই গ্রামের ঐতিহ্য ও সাফল্য দুইই ঈর্ষনীয়। শুধু মাটিয়ারি নয়, আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের বহু মানুষ প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
ভবানন্দের পৌত্র রাজা রাঘব রায় এখানে ১৫৮৭ শকে্ (১৬৬৫ খ্রীঃ ) ইটের তৈরি অলংকরণ যুক্ত দক্ষিণমুখী এক চারচালা মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে কৃষ্ণমর্মর নির্মিত ‘ রুদ্রেশ্বর ‘ নামে শিবলিঙ্গটি এখনও নিত্যপূজিত। রাঘব তাঁর পুত্র রুদ্রের নামানুসারে শিবের নামকরণ করেছিলেন বলে শোনা যায়।
এ মন্দিরের টেরাকোটা সজ্জার বিশেষত্ব বর্মধারী, সশস্ত্র মোগলমূর্তির আধিক্য। মূলত দেওয়ালের সামনে দুদিকেই সাতটি ও ছয়টি মোগল মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। নদীয়া জেলার অন্য কোনও মন্দিরে এত অধিকসংখ্যক মোগল সৈন্যের প্রতি কৃতি দেখা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, এ দেবালয় প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরে, ১০৮৭ হিজরীতে (১৬৭৬ খ্রীঃ) নদীয়ারাজ রুদ্র রায় মোগল সম্রাট আলমগীরের কাছ থেকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, খাড়ি, জুড়ি প্রভৃতি বিস্তীর্ণ পরগণার ভূস্বামীত্বের ফরমান লাভ করেন।
PMFME ঋণ: ক্ষুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ উদ্যোগের জন্য সুবর্ণ সুযোগ!
মন্দিরের খিলানগুলি মূলত পত্রাকৃতি ছিল। এছাড়াও মন্দিরের জ্যামিতিক অলংকরণও রয়েছে। বাঁ দিকে পাদপীঠ সংলগ্ন সারিতে গজ ও অশ্বারোহীদের যুদ্ধদৃশ্য, বস্ত্রহরণ, নৌকা বিলাস প্রভৃতি আর ডানদিকে মিথুন মূর্তি, কৃষ্ণলীলা, ইউরোপীয় ব্যাঘ্র শিকার, হরিণ শিকার হরিণের প্রাণ ভয়ে পলায়ন, সজ্জিত হাতি ইত্যাদির ভাস্কর্য নিবদ্ধ, একটি সুন্দর হংসপঙক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শোনা যায়, ভবানন্দ মজুমদার এখানে অন্নপূর্ণা। দেবীর আর একটি মন্দির ও নির্মাণ করেছিলেন এবং তাঁর প্রাসাদেই নাকি নদীয়ারাজ হন। কিন্তু এখন আর সেই মন্দিরের কোনো চিহ্ন নেই। হজরত সাউ মুলকে গোজ বা বাবা বুড়ো সাহেবে’র একটি দরগা, যেটি নদীয়া জেলার মুসলমানদের দরগাগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। এখানে হিন্দু মুসলমান সকলেই নির্বিশেষে মানত করত, কোনো ভেদাভেদ বলতে কিছুই ছিল না। দরগাটির আর একটি প্রচলিত নাম – মল্লিক গস্ এর দরগা। ‘মল্লিক গস্ ‘ উপাধি বিশেষ , ‘মলি অল গস্’ শব্দ থেকে রূপান্তর হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ‘মলি অল‘ বলতে বাদশা এবং ‘গস্’ বলতে ফকির বোঝায়।
কথিত আছে, ভবানন্দ মজুমদারের রাজধানী স্থাপনাকালে হজরত সাউ মুলকে গোজ নামে এক সিদ্ধপীর ও তাঁর ভাই করিম দুজন শিষ্যসহ এখানে আসেন। করিম ও পরে সিদ্ধপীর হন, মৃত্যু হলে তাঁদের এই দরগায় কবর দেওয়া হয়। দরগাটি এখন নাকি বিধ্বস্ত ও জঙ্গলাকীর্ণ। শোনা যায়, আদিতে এটি নাকি আগাগোড়া প্রস্তর নির্মিত ছিল। প্রতি বছর অম্বুবাচী তিথিতে পীরের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এই সমাধিকে ঘিরে মেলা বসে।।
কবিকঙ্কণ এর ‘ চন্ডীমঙ্গল ‘ কাব্যে শ্রীমন্ত সদাগরের সিংহল যাত্রা প্রসঙ্গে এই গ্রামের উল্লেখ আছে।
-রিয়া দাস (রাই)
তথ্যসূত্র: বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ – শিবনাথ শাস্ত্রী। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নদীয়া – নিতাই ঘোষ