বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের এই ১০টি কাজ জরুরি! না মানলে হতে পারে বিপদ

সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নারীদের প্রস্তুতিই যথেষ্ট নয়। বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেকেই উপেক্ষা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ধ্যাত্বের ৫০% ক্ষেত্রেই পুরুষদের কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে।…

Debolina Roy

 

সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নারীদের প্রস্তুতিই যথেষ্ট নয়। বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেকেই উপেক্ষা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ধ্যাত্বের ৫০% ক্ষেত্রেই পুরুষদের কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে। তাই একটি সুস্থ শিশু পেতে হলে পুরুষদেরও সন্তান নেওয়ার কমপক্ষে তিন মাস আগে থেকেই বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ নতুন শুক্রাণু তৈরি হতে প্রায় ৪২-৭৬ দিন সময় লাগে।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, যা আপনার পারিবারিক জীবনে সুখ এনে দিতে পারে।

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন

বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় তালিকার প্রথমেই রয়েছে আদর্শ ওজন বজায় রাখা। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ওজনের পুরুষদের স্বাভাবিক ওজনের তুলনায় কম শুক্রাণু উৎপাদনের সম্ভাবনা ১১% বেশি এবং একদমই শুক্রাণু না থাকার আশঙ্কা ৩৯% বেশি।

স্থূল পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ:

  • কম শুক্রাণুর সংখ্যার ঝুঁকি ৪২% বেশি

  • শুক্রাণুহীনতার আশঙ্কা ৮১% বেশি

তবে আশার কথা হলো, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে স্থূল পুরুষরা ৮ সপ্তাহের কম ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে ওজন কমালে তাদের বীর্যের গুণমান উন্নত হয়।

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন

সুস্থ শুক্রাণুর জন্য সঠিক পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান গুলো গ্রহণ করুন:

শুক্রাণুর গুণমান বৃদ্ধিকারী পুষ্টি উপাদান:

  • ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড

  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (ভিটামিন ই, ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন)

  • সেলেনিয়াম ও জিংক

  • ক্রিপ্টোক্স্যান্থিন ও লাইকোপেন

  • ভিটামিন ডি ও ফলেট

এড়িয়ে চলুন:

  • প্রক্রিয়াজাত মাংস

  • অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার

  • স্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাট

ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করুন

ধূমপান পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সিগারেট বীর্যের গুণমানের উপর বিভিন্নভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে:

  • শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস

  • বীর্যের পরিমাণ কমে যাওয়া

  • শুক্রাণুর গতিশীলতা হ্রাস

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: এমনকি দিনে ১০টির কম সিগারেট পানকারীদের (হালকা ধূমপায়ী) শুক্রাণুর গুণমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধূমপান গর্ভধারণের সময় ভবিষ্যৎ সন্তানের শৈশবকালীন লিউকেমিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

অ্যালকোহল সেবন সীমিত করুন

বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে:

  • মাঝে মাঝে অ্যালকোহল সেবনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই

  • প্রতিদিন অ্যালকোহল সেবন বীর্যের পরিমাণ ও আকৃতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে

২০২৩ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাপ্তাহিক ৭ ইউনিটের বেশি অ্যালকোহল সেবনে বীর্যের পরিমাণ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রজনন হরমোন কমে যায়।

অতিরিক্ত মদ্যপানের অন্যান্য সমস্যা:

  • লিঙ্গ উত্থান ও বজায় রাখতে সমস্যা

  • যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস

  • যৌন কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া

নিয়মিত ব্যায়াম করুন কিন্তু অতিরিক্ত নয়

গর্ভধারণ থেকে প্রসব পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে পুরুষেরও শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। নিয়মিত ব্যায়াম:

  • গর্ভধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে

  • প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়

  • মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে

সতর্কতা: অতিরিক্ত কঠোর ব্যায়াম প্রজনন ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মাঝারি মাত্রার ব্যায়ামের দিকে মনোযোগ দিন।

যৌনবাহিত সংক্রমণের জন্য পরীক্ষা করান

বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে STI স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা না করা হলে ক্ল্যামিডিয়া বা গনোরিয়ার মতো সংক্রমণ প্রজনন অঙ্গের ক্ষতি করে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • অনেক STI-তে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না

  • বেশিরভাগ STI দ্রুত ও সহজে চিকিৎসাযোগ্য

  • নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো উচিত

ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ এড়িয়ে চলুন

পরিবেশগত ক্ষতিকর পদার্থ পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে নিম্নলিখিত পদার্থগুলো এড়িয়ে চলুন:

এড়িয়ে চলার তালিকা:

  • কীটনাশক ও আগাছানাশক

  • ভারী ধাতু (সীসা, পারদ)

  • গৃহস্থালীর রাসায়নিক পদার্থ

  • এন্ডোক্রিন ডিসরাপটিং কেমিক্যাল যুক্ত প্লাস্টিক

এই রাসায়নিক পদার্থগুলো শরীরে জমা হতে থাকে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো এড়ানো শুরু করুন।

ওষুধ ও অবৈধ মাদক বন্ধ করুন

কিছু ওষুধ ও মাদকদ্রব্য পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে অ্যানাবলিক স্টেরয়েড ব্যবহার প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে এবং শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমানের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

করণীয়:

  • সকল ধরনের অবৈধ মাদক ব্যবহার বন্ধ করুন

  • প্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করুন

  • প্রজনন ক্ষমতার উপর প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন

চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন

বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রি-কনসেপশন চেকআপে যা অন্তর্ভুক্ত থাকে:

ঝুঁকি মূল্যায়ন:

  • যৌনবাহিত সংক্রমণের ইতিহাস

  • দীর্ঘমেয়াদী রোগের ইতিহাস

  • ওষুধের তালিকা পর্যালোচনা

  • পারিবারিক জিনগত রোগের ইতিহাস

স্বাস্থ্য প্রচার:

  • ওজন ব্যবস্থাপনা পরামর্শ

  • পুষ্টি নির্দেশনা

  • মানসিক চাপ কমানোর উপায়

  • প্রয়োজনীয় টিকাদান

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন

অতিরিক্ত মানসিক চাপ শুক্রাণুর গুণমান ও পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া জরুরি।

মানসিক চাপ কমানোর উপায়:

  • নিয়মিত ধ্যান বা যোগব্যায়াম

  • পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা)

  • পছন্দের কাজে সময় দেওয়া

  • পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা

  • প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

সঠিক সময়ে পরিকল্পনা করুন

বয়স বৃদ্ধির সাথে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাও প্রভাবিত হয়। যদিও নারীদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে বয়সের প্রভাব কম স্পষ্ট, তবুও ৪০ বছরের আগে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করা ভাল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩০ বছরের পর নারীদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায় এবং ৩৫ বছরের পর তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই দম্পতির উভয়েরই সঠিক সময়ে পরিকল্পনা করা উচিত।

সন্তান ধারণ একটি দম্পতির যৌথ দায়িত্ব এবং বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় বিষয়টি অবহেলা করা মোটেও উচিত নয়। উপরে বর্ণিত নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর পারিবারিক জীবনের ভিত্তি গড়তে পারেন। মনে রাখবেন, প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কমপক্ষে তিন মাস সময় দিন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। এই ছোট পদক্ষেপগুলোই আপনার ভবিষ্যৎ সন্তানের সুস্বাস্থ্য ও সুখী পারিবারিক জীবন নিশ্চিত করতে পারে।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।