মেসি-রোনাল্ডো: দুই মহাতারকার অবদানে বদলে গেছে বিশ্ব ফুটবলের চেহারা”গত দুই দশকে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে যে দুজন খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন, তারা হলেন লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। এই দুই মহাতারকার প্রতিভা, পারফরম্যান্স এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও ফুটবল জগতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই দুই কিংবদন্তি খেলোয়াড় বিশ্ব ফুটবলের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন।
লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো দুজনেই নিজ নিজ ক্যারিয়ারে অসংখ্য রেকর্ড গড়েছেন। মেসি রেকর্ড ৮ বার বালন ডি’অর জিতেছেন, যা ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে রোনাল্ডো ৫ বার এই সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত মেসি ৮৩৭টি গোল করেছেন, আর রোনাল্ডো করেছেন ৮৯৫টি। এছাড়া মেসি ৩৭৪টি অ্যাসিস্ট করেছেন, যেখানে রোনাল্ডোর অ্যাসিস্ট সংখ্যা ২৫২টি।
মেসি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় বার্সেলোনায় কাটিয়েছেন, যেখানে তিনি ১০টি লা লিগা ও ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছেন। অন্যদিকে রোনাল্ডো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসে খেলে ৭টি লিগ শিরোপা ও ৫টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি জিতেছেন। দুজনেই বিভিন্ন লিগে সফল হয়ে নিজেদের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
মেসি ২০২২ সালে আর্জেন্টিনাকে ফিফা বিশ্বকাপ জেতানোর পর ২০২৩ সালে রেকর্ড অষ্টম বালন ডি’অর জিতেছেন। তিনি ২০২১ সালে কোপা আমেরিকাও জিতেছেন। রোনাল্ডো পর্তুগালকে ২০১৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও ২০১৯ সালে ইউইএফএ নেশন্স লিগ জেতানোর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মেসি ও রোনাল্ডো দুজনেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ফুটবলারদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। এনড্রিক, হালান্ড, এমবাপ্পে, সাকা, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রদ্রিগোর মতো তরুণ তারকারা রোনাল্ডোকে তাদের আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে জুলিয়ান আলভারেজ ও জুড বেলিংহাম মেসিকে তাদের রোল মডেল হিসেবে দেখেন।
মেসি ও রোনাল্ডোর প্রভাব শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের জনপ্রিয়তা ফুটবল শিল্পের ব্যবসায়িক দিকেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, মেসির ইন্টার মায়ামিতে যোগদানের পর ক্লাবটি ইনস্টাগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ সর্বাধিক অনুসরণকৃত স্পোর্টস টিম হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে রোনাল্ডোর আল-নাসরে যোগদানের পর ক্লাবটির ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার সংখ্যা ৮৩৪,০০০ থেকে বেড়ে ২৪.৬ মিলিয়ন হয়েছে।
মেসি ও রোনাল্ডো দুজনেই তাদের বর্তমান লিগের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। মেসির আগমনে মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অ্যাপল টিভি এমএলএসের সম্প্রচার অধিকার পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে রোনাল্ডোর যোগদানের পর সৌদি প্রো লিগে নেইমার, করিম বেনজেমা, এনগোলো কান্তের মতো বিশ্বমানের খেলোয়াড়রা এসেছেন।
মেসি ও রোনাল্ডো দুজনেই স্বীকার করেছেন যে তাদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন অতীত। তবে তাদের অবদান ফুটবলের ইতিহাসকে চিরকাল প্রভাবিত করবে। রোনাল্ডো বলেছেন, “আমরা ফুটবলের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছি। আমরা সারা বিশ্বে সম্মানিত, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
১. প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় (২০০৬)
মেসির প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় আসে ২০০৬ সালে, যখন বার্সেলোনা আর্সেনালকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। যদিও তিনি ফাইনালে খেলেননি, তবে এই জয় তার ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
ICC Trophy History: বিরাট কোহলির অসাধারণ রেকর্ড: ক্রিকেট বিশ্বে নতুন কীর্তি গড়লেন রান মেশিন!
২. ২০০৭ সালের এল ক্লাসিকো হ্যাটট্রিক
২০০৭ সালের মার্চ মাসে, মেসি রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে তার প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। এই ম্যাচটি ৩-৩ গোলে ড্র হয় এবং মেসির এই পারফরম্যান্স তাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলে।
৩. গেটাফের বিপক্ষে গোল (২০০৭)
২০০৭ সালে গেটাফের বিপক্ষে মেসির গোলটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা গোলের মতোই ড্রিবল করে এই গোলটি করেন।
৪. প্রথম বালন ডি’অর জয় (২০০৯)
২০০৯ সালে মেসি তার প্রথম বালন ডি’অর জয় করেন। এই বছর তিনি বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা, কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ট্রেবল অর্জন করেন।
৫. ২০১১ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল
২০১১ সালে মেসি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোল করেন এবং বার্সেলোনা ৩-১ গোলে জয়ী হয়। এই ম্যাচে তার পারফরম্যান্স তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
৬. ২০১২ সালে গার্ড মুলারের রেকর্ড ভাঙা
২০১২ সালে মেসি এক ক্যালেন্ডার বছরে ৯১টি গোল করে গার্ড মুলারের রেকর্ড ভাঙেন। এটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় অর্জন।
৭. ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল
২০১৪ সালে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে যান মেসি। যদিও তারা জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায়, তবে মেসি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল জেতেন।
৮. ২০২১ কোপা আমেরিকা জয়
২০২১ সালে মেসি আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জিতিয়ে তার দেশের হয়ে প্রথম বড় আন্তর্জাতিক শিরোপা অর্জন করেন। এই জয় তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় মুহূর্ত।
৯. ২০২২ বিশ্বকাপ জয়
২০২২ সালে মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন করেন। এই টুর্নামেন্টে তিনি ৭টি গোল করেন এবং ফাইনালে ২টি গোল করেন।
১. প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় (২০০৮)
২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে চেলসির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে রোনাল্ডো তার প্রথম বড় ইউরোপীয় শিরোপা অর্জন করেন। এই ম্যাচে তিনি একটি গোল করেন এবং পেনাল্টি শুটআউটে গোল মিস করেন।
২. রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান (২০০৯)
২০০৯ সালে রোনাল্ডো রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন এবং তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল সময় শুরু হয়। তিনি রিয়ালের হয়ে ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জেতেন।
৩. ২০১৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল
২০১৪ সালে রোনাল্ডো রিয়াল মাদ্রিদকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে জিতিয়ে দেন। এই ম্যাচে তিনি একটি গোল করেন এবং রিয়াল ৪-১ গোলে জয়ী হয়।
মেসি যুগের অবসানের পর কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে আর্জেন্টিনা?
৪. ইউরো ২০১৬ জয়
২০১৬ সালে রোনাল্ডো পর্তুগালকে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতিয়ে দেন। ফাইনালে তিনি ইনজুরির কারণে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন, তবে তার নেতৃত্বে পর্তুগাল ১-০ গোলে ফ্রান্সকে পরাজিত করে।
৫. ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল
২০১৭ সালে রোনাল্ডো জুভেন্টাসের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ২টি গোল করেন এবং রিয়াল মাদ্রিদ ৪-১ গোলে জয়ী হয়। এই জয়ে রিয়াল টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে।
৬. ২০১৮ সালে জুভেন্টাসে যোগদান
২০১৮ সালে রোনাল্ডো জুভেন্টাসে যোগ দেন এবং তার প্রথম মৌসুমেই সিরি আ শিরোপা জেতেন। তিনি ইতালির প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ইংল্যান্ড, স্পেন এবং ইতালির লিগ শিরোপা জেতেন।
৭. ২০২১ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তন
২০২১ সালে রোনাল্ডো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে আসেন এবং তার প্রথম ম্যাচেই ২টি গোল করেন। এই প্রত্যাবর্তন তার ক্যারিয়ারের একটি বড় মুহূর্ত।
৮. আল-নাসরে যোগদান (২০২২)
২০২২ সালে রোনাল্ডো সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল-নাসরে যোগ দেন এবং তার প্রথম মৌসুমেই লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
মেসি ও রোনাল্ডোর প্রতিভা, পরিশ্রম ও নৈপুণ্য বিশ্ব ফুটবলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাদের প্রভাব শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক। এই দুই মহাতারকার অবদান ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং আগামী প্রজন্মের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। তাদের উত্তরাধিকার ফুটবল জগতকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং খেলাটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন