আইসিআইসিআই ব্যাংকের ৫০ হাজার টাকার শর্ত থেকে এসবিআই’র জিরো ব্যালেন্স সুবিধা, কোন ব্যাংক কি দিচ্ছে আপনাদের?

মনীষা মুখার্জী 6 Min Read

দেশের অন্যতম প্রধান প্রাইভেট ব্যাংক আইসিআইসিআই ব্যাংক গত ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত পাঁচগুণ বৃদ্ধি করেছে। মেট্রো ও শহুরে এলাকায় এখন ৫০ হাজার টাকা গড় মাসিক ব্যালেন্স রাখতে হবে, যা আগে ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। এই পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকিং খাতে মিনিমাম ব্যালেন্স নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষত যখন অন্যদিকে এসবিআই, ব্যাংক অব বরোদা, পিএনবিসহ একাধিক সরকারি ব্যাংক গ্রাহকদের সুবিধার জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত একেবারেই তুলে দিয়েছে।

আইসিআইসিআই ব্যাংকের এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ১ আগস্ট ২০২৫ বা তার পরে খোলা নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে মেট্রো ও আর্বান এলাকায় ৫০ হাজার টাকা, সেমি-আর্বান এলাকায় ২৫ হাজার টাকা এবং গ্রামীণ এলাকায় ১০ হাজার টাকা গড় মাসিক ব্যালেন্স রাখতে হবে। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র নতুন গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য, বর্তমান অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের ক্ষেত্রে পুরাতন নিয়মই বলবৎ থাকবে। মিনিমাম ব্যালেন্স বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ৬ শতাংশ জরিমানা বা ৫০০ টাকা – যেটি কম হবে সেটি কাটা হবে।

এসবিআই গ্রাহকদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, কারণ ২০২০ সাল থেকেই এই ব্যাংক সকল সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছে। এর ফলে এসবিআই’র যেকোনো সেভিংস অ্যাকাউন্টে জিরো ব্যালেন্স রাখা যায় এবং কোনো জরিমানাও দিতে হয় না। এসবিআই চেয়ারম্যান সিএস সেট্টি সম্প্রতি জানিয়েছেন যে এই নীতি প্রথমবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা গ্রাহকদের অনেক সাহায্য করেছে। 

টাকা বাঁচানোর ১০টি সেরা উপায় যা আপনার জীবন বদলে দিতে পারে

এইচডিএফসি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এখনও নিয়মিত সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মেট্রো ও আর্বান এলাকায় ১০ হাজার টাকা, সেমি-আর্বান এলাকায় ৫ হাজার টাকা এবং গ্রামীণ এলাকায় ২ হাজার ৫০০ টাকা গড় মাসিক ব্যালেন্স রাখতে হয়। এইচডিএফসি ব্যাংক তাদের বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, সেভিংস ম্যাক্স অ্যাকাউন্টের জন্য ২৫ হাজার টাকা মিনিমাম ব্যালেন্স প্রয়োজন।

অ্যাক্সিস ব্যাংকের ইজি অ্যাক্সেস সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মেট্রো ও আর্বান এলাকায় ১২ হাজার টাকা, সেমি-আর্বান এলাকায় ৫ হাজার টাকা এবং গ্রামীণ এলাকায় ২ হাজার ৫০০ টাকা মিনিমাম ব্যালেন্স রাখতে হয়। অ্যাক্সিস ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্টের জন্য মিনিমাম ব্যালেন্স ১২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা নির্ভর করে অ্যাকাউন্টের ধরনের উপর।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিক সরকারি ব্যাংক গ্রাহক-বান্ধব পদক্ষেপ নিয়ে মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছে। ব্যাংক অব বরোদা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে সকল স্ট্যান্ডার্ড সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের জরিমানা তুলে দিয়েছে। তবে এটি প্রিমিয়াম সেভিংস অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একইভাবে, ইন্ডিয়ান ব্যাংক ৭ জুলাই ২০২৫ থেকে, কানারা ব্যাংক মে ২০২৫ থেকে এবং পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক (পিএনবি) তাদের সকল সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের জরিমানা বাতিল করেছে।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) স্পষ্ট করেছে যে সেভিংস অ্যাকাউন্টে মিনিমাম ব্যালেন্স রাখার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা জারি করেনি। ব্যাংকগুলো নিজেদের নীতি অনুযায়ী এই শর্ত নির্ধারণ করে থাকে। তবে জন ধন যোজনার অ্যাকাউন্ট এবং বেসিক সেভিংস ব্যাংক ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট (বিএসবিডিএ) সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত থেকে মুক্ত।

ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে আইসিআইসিআই ব্যাংকের এই পদক্ষেপ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা আরও প্রিমিয়াম গ্রাহকদের দিকে মনোনিবেশ করতে চায়। এটি বিদেশি ব্যাংকগুলোর মতো কৌশল, যারা সাধারণত উচ্চ আয়ের গ্রাহকদের টার্গেট করে থাকে। অন্যদিকে, সরকারি ব্যাংকগুলো আরও বেশি গ্রাহক আকর্ষণ এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য মিনিমাম ব্যালেন্সের শর্ত তুলে দিচ্ছে।

আইসিআইসিআই ব্যাংকের এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে কারেন্ট অ্যান্ড সেভিংস অ্যাকাউন্ট (কাসা) ডিপোজিটের অংশ বৃদ্ধি এবং অপারেটিং খরচ কমানোর প্রচেষ্টা। ব্যাংকিং খাতে কাসা ডিপোজিটের অংশ কমে গিয়ে মার্চ ২০২৫-এ মোট ডিপোজিটের ৩৬.৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের বছর ছিল ৩৯.২ শতাংশ। এর বিপরীতে টার্ম ডিপোজিট ও সার্টিফিকেট অব ডিপোজিট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩.২ শতাংশে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যয়বহুল ফান্ডিং সোর্স।

গ্রাহকদের উপর এই পরিবর্তনের প্রভাব তাৎক্ষণিক এবং উল্লেখযোগ্য। আইসিআইসিআই ব্যাংকের নতুন অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের যারা শহুরে এলাকায় ৫০ হাজার টাকা রাখতে পারবেন না, তাদের মাসিক জরিমানা গুনতে হতে পারে। এটি কিছু ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম ব্যাংকিং পণ্যের চেয়েও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী বা কম আয়ের মানুষদের জন্য এই পরিবর্তন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। 

অনলাইনে SBI অ্যাকাউন্ট শাখা পরিবর্তন করুন মাত্র কয়েকটি ক্লিকে: সম্পূর্ণ গাইড

অপরদিকে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মিনিমাম ব্যালেন্স তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে উপকারী হয়েছে প্রথমবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা গ্রাহকদের জন্য। জন ধন যোজনার মাধ্যমে ৫০ কোটিরও বেশি নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, যার অধিকাংশই ধীরে ধীরে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম বৃদ্ধি করছে। আরবিআই’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, জন ধন অ্যাকাউন্টগুলোর গড় ব্যালেন্স বার্ষিক ১৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিকাশ ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট সেবা প্রদানের খরচ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে অনেক ব্যাংক এখন ব্যালেন্স-সংক্রান্ত জরিমানা তুলে দিয়ে ডেবিট কার্ড ফি এবং লেনদেন চার্জের মতো অন্যান্য উৎস থেকে আয় করছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে এই দ্বিমুখী পদ্ধতি – প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর প্রিমিয়াম গ্রাহক-কেন্দ্রিক এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যাপক গ্রাহক আকর্ষণমূলক কৌশল – আগামী কয়েক বছরে সেভিংস অ্যাকাউন্ট বাজারের অংশীদারিত্ব পরিবর্তন করতে পারে। গ্রাহকদের এখন আরও সচেতনভাবে তাদের ব্যাংকিং প্রয়োজন এবং আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করে ব্যাংক বেছে নিতে হবে। যারা নিয়মিত উচ্চ ব্যালেন্স রাখতে পারেন, তাদের জন্য আইসিআইসিআই ব্যাংকের মতো প্রাইভেট ব্যাংকের প্রিমিয়াম সেবা উপকারী হতে পারে। আর যারা কম ব্যালেন্স রাখেন বা প্রথমবার ব্যাংকিং শুরু করছেন, তাদের জন্য এসবিআই বা অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের জিরো ব্যালেন্স সুবিধা বেশি সুবিধাজনক।

Share This Article