AI-generated war clips: গত কিছুদিন ধরে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে এআই-নির্ভর ভুয়া ভিডিও, গেমিং ক্লিপ আর পুরনো ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ছে, তা নজিরবিহীন। পাকিস্তানের ঘটনা কিংবা ভিডিও গেমের দৃশ্যকেও ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের বাস্তব চিত্র বলে চালানো হচ্ছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর পর থেকেই এই ডিজিটাল বিভ্রান্তির ঢেউ শুরু হয়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই বাস্তব সংঘাতের পাশাপাশি অনলাইনে শুরু হয় তথ্যযুদ্ধ, যেখানে এআই-জেনারেটেড ভিডিও, গেমিং ফুটেজ, পুরনো প্রতিবাদ বা যুদ্ধের দৃশ্য নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।
বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া এসব ভিডিওর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি। উদাহরণস্বরূপ, টেল আভিভে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার দৃশ্য দেখানো একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়, যদিও পরে প্রমাণিত হয় সেটি গুগলের এআই টুল দিয়ে বানানো। একইভাবে, ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের দৃশ্য, ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর, কিংবা ইরানের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ভিডিও—এসবই ছিল এআই-নির্ভর ভুয়া কনটেন্ট, যা TikTok, Facebook, Instagram ও X-এ ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু এআই-নির্ভর ভিডিও নয়, পাকিস্তানের পুরনো ঘটনা বা ভিডিও গেমের ক্লিপও ব্যবহার করা হয়েছে। একাধিকবার পাকিস্তানের সামরিক হামলার নামে ‘ISPR’ ট্যাগযুক্ত ভিডিও ছড়ানো হয়, যেখানে দেখা যায় আকাশ থেকে হামলার দৃশ্য। পরে যাচাই করে দেখা যায়, এটি আসলে ২০১৫ সালে ইউটিউবে প্রকাশিত ‘Arma 2’ নামের ভিডিও গেমের দৃশ্য। এমনকি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে টানাপোড়েনের সময়ও এ ধরনের গেমিং ক্লিপকে বাস্তব হামলা বলে চালানো হয়েছিল।
আরেকটি বড় প্রবণতা হলো পুরনো প্রতিবাদ বা যুদ্ধের ফুটেজ নতুন সংঘাতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। যেমন, ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পুরনো ভিডিওকে নতুন করে ছড়িয়ে বলা হচ্ছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পর ইরানিরা সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। একইভাবে, ইউক্রেন, চীন, এমনকি ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের ভিডিওকেও ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের দৃশ্য বলে চালানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ডিজিটাল বিভ্রান্তি ছড়ানোর পেছনে রয়েছে ‘এনগেজমেন্ট ফার্মার’ নামে পরিচিত কিছু গ্রুপ, যারা অনলাইনে বেশি ভিউ ও ফলোয়ার পেতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া কনটেন্ট ছড়ায়। অনেক সময় এসব অ্যাকাউন্টের নাম ও প্রোফাইল এতটাই বিশ্বাসযোগ্যভাবে সাজানো হয় যে সাধারণ ব্যবহারকারীরা সহজেই বিভ্রান্ত হন। উদাহরণস্বরূপ, ‘Daily Iran Military’ নামে একটি প্রো-ইরানিয়ান অ্যাকাউন্ট মাত্র এক সপ্তাহে ৭ লাখ থেকে ১৪ লাখ ফলোয়ারে পৌঁছে যায়, মূলত ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে।
এআই-নির্ভর ডিজিটাল বিভ্রান্তি এত দ্রুত ছড়াচ্ছে যে, অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়ার নিজস্ব এআই চ্যাটবটও এসব ভিডিওকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যেমন, X-এর ‘Grok’ চ্যাটবটকে যখন কোনো ভিডিওর সত্যতা যাচাই করতে বলা হয়, তখন সেটি ভুল তথ্যকে সত্য বলে মেনে নেয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এআই-নির্ভর ভুয়া তথ্য ছড়ানোর এই ঢেউ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতাকেই আড়াল করছে না, বরং সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ও ভুল ধারণা ছড়াচ্ছে। অনেক সময় এসব ভিডিও বা ছবি এতটাই বাস্তবসম্মত হয় যে, সাধারণ ব্যবহারকারী তো বটেই, এমনকি সাংবাদিক বা বিশ্লেষকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
বিশ্বজুড়ে এই ডিজিটাল বিভ্রান্তি ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা আরও শক্তিশালী যাচাইকরণ ও কনটেন্ট মডারেশন ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কনটেন্ট মডারেশন কমিয়ে দিচ্ছে, ফলে ভুয়া তথ্য আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
সবশেষে বলা যায়, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের বাস্তবতা যেমন ভয়াবহ, তার চেয়ে কম নয় ডিজিটাল যুদ্ধের ভয়াবহতা। এআই-নির্ভর ভুয়া কনটেন্ট, গেমিং ক্লিপ আর পুরনো ভিডিওর মিশেলে সত্য-মিথ্যার সীমারেখা ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সচেতনতা, মিডিয়া লিটারেসি এবং তথ্য যাচাইয়ের দক্ষতা আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে।