Budget 2024: ২০২৪ সালের ২৩শে জুলাই। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ লোকসভায় দাঁড়িয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তটি শুধু একটি বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন নয়, এটি মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বড় নীতিগত ঘোষণা। দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এই বাজেটের উপর নির্ভর করছে। কী থাকতে পারে এই বাজেটে? কোন খাতে বরাদ্দ বাড়বে? কোথায় হতে পারে কর ছাড়? চলুন জেনে নেওয়া যাক এই বাজেটের সম্ভাব্য দিকগুলি।
মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের এই প্রথম বাজেট ভারতের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রণীত হচ্ছে। সম্প্রতি, ১১ই জুলাই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সাথে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিডিও ইন্ডিয়ার পার্টনার রোহিন কাপুর সুপারিশ করেছেন যে শিক্ষা খাতে ব্যয় দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৫% করা উচিত। এছাড়াও তিনি নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি করেছেন:
– কে-১২ সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি স্বচ্ছ কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো চালু করা
– প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অনিয়ম রোধে ডিজিটাল পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ ঘোষণা
– উচ্চ শিক্ষার জন্য একক নিয়ন্ত্রক গঠনে হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (HECI) বিল পুনরায় প্রবর্তন
– শিক্ষকতাকে পছন্দের পেশা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি
– “শিক্ষক প্রশিক্ষণ” উদ্যোগে বরাদ্দ বৃদ্ধি
ছোট ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) খাতে বিশেষ নজর দেওয়া হতে পারে এই বাজেটে। স্ট্রেটেফিক্স কনসাল্টিং-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুকুল গোয়েল মনে করেন, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি দিয়েছেন:
– স্বয়ংক্রিয়করণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তথ্য বিশ্লেষণের মতো ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত দক্ষতা বিকাশের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ
– কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগকারী এমএসএমইগুলিকে কর ছাড় ও ভর্তুকি প্রদান
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্পোরেশন (NSDC) এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মাত্র ১০% শ্রমিক আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পায়, যা উন্নত দেশগুলিতে ৬০-৯০%। এই ব্যবধান কমানো একটি প্রধান লক্ষ্য হতে পারে।
এসবিআই রিসার্চ ব্যাংকগুলির সুস্থ অবস্থার কথা উল্লেখ করে সরকারি খাতের ব্যাংক (পিএসবি) বিনিবেশ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে[2]। তারা বিনিবেশের একটি শক্তিশালী রোডম্যাপ তৈরির উপর জোর দিয়েছে, যা মূলধন প্রবাহ বাড়াতে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে।
ভারতীয় মেডিকেল ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (AiMeD) মেডিকেল ডিভাইসের উপর কাস্টমস শুল্ক ১০-১৫% পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
সেলুলার অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (COAI) টেলিকম সরঞ্জামের উপর কাস্টমস শুল্ক ছাড়, লাইসেন্স ফি ও স্পেকট্রাম ব্যবহার চার্জের জন্য জিএসটি ছাড়, এবং নিলামে অর্জিত স্পেকট্রামের জন্য ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা লাইসেন্স ফি ৩% থেকে কমিয়ে ১% করার প্রস্তাবও দিয়েছে।
ভ্রমণ ও পর্যটন খাত হোটেলগুলির জন্য একটি সুসংগত ১২% জিএসটি হার প্রবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে[2]। এর লক্ষ্য হল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন উৎসাহিত করা।
অটোমোবাইল শিল্প জিএসটি হ্রাস, ইলেকট্রিক যানবাহনের জন্য প্রণোদনা, যানবাহন স্ক্র্যাপেজ নীতি, এবং গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের প্রত্যাশা করছে[3]।
– স্বাস্থ্য বীমার জন্য নতুন কর কাঠামোর অধীনে বর্ধিত কর সুবিধা
– এমএসএমইগুলির জন্য শিথিল পেমেন্ট নিয়ম
– কৃষি-প্রযুক্তি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য বিমা সংক্রান্ত কোন নতুন নীতি আসতে পারে
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য বিমা সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নতুন নীতি আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে:
– আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের সুবিধাভোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আসবে।
– ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে সকল বয়স্ক নাগরিককে এই প্রকল্পের আওতায় আনার প্রস্তাব রয়েছে।
– বর্তমানে যে ৫ লক্ষ টাকার বার্ষিক বিমা সুরক্ষা দেওয়া হয়, তা বাড়িয়ে ১০ লক্ষ টাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
– স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামের উপর আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে বিমা কোম্পানিগুলো।
– বর্তমানে আয়কর আইনের ৮০ডি ধারায় যে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া হয়, তা বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।
– নতুন কর ব্যবস্থার আওতায়ও স্বাস্থ্য বিমার জন্য কর সুবিধা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
– স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামের উপর জিএসটি কমানোর প্রস্তাব রয়েছে।
– বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্য বিমা প্রিমিয়ামের উপর কর ছাড়ের সীমা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
– ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে বিমার সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।
এই নীতিগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের স্বাস্থ্য বিমা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি সহজতর হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এবারের বাজেটে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে বা কমতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পূর্ববর্তী বাজেটের ধারা বিবেচনা করে কিছু অনুমান করা যায়:
– সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য
– আমদানিকৃত ইলেকট্রনিক্স পণ্য যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি
– বিলাসবহুল পণ্য যেমন গহনা, উচ্চমূল্যের কার ইত্যাদি
– পেট্রোল ও ডিজেল
– ইলেকট্রিক গাড়ি
– সৌর প্যানেল ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন সরঞ্জাম
– কৃষি যন্ত্রপাতি
– দেশীয় উৎপাদিত ইলেকট্রনিক্স পণ্য
তবে এগুলো কেবল অনুমান। বাজেট ঘোষণার পর সঠিক তথ্য জানা যাবে। সরকার সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তাই এবারের বাজেটেও এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
১. পরিকাঠামো উন্নয়ন:
– রেলওয়ে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক নির্মাণে বরাদ্দ বাড়তে পারে।
– সরকার পরিকাঠামো খাতে মোট জিডিপির ৩.৫% পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়াতে পারে।
২. কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন:
– কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে।
– গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বরাদ্দ বাড়তে পারে।
৩. প্রতিরক্ষা খাত:
– স্বদেশী প্রতিরক্ষা উৎপাদন বাড়াতে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
৪. নবায়নযোগ্য শক্তি:
– সৌর শক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
৫. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন:
– শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
– দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
৬. স্বাস্থ্যসেবা:
– স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প সম্প্রসারণে বরাদ্দ বাড়তে পারে।
৭. ডিজিটাল পরিকাঠামো:
– ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশনের আওতায় ডিজিটাল পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
৮. এমএসএমই খাত:
– ছোট ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, পরিকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি, প্রতিরক্ষা, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
এবারের বাজেটে কোন খাতে ব্যয় কমানো হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি খাতে ব্যয় কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে:
১. ভর্তুকি: সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা করতে পারে। বিশেষ করে জ্বালানি ও সার ভর্তুকি কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
২. কৃষি: গত বছরের তুলনায় কৃষি খাতে বরাদ্দ কিছুটা কম হতে পারে। বিশেষ করে ফসল বীমা প্রকল্পে বরাদ্দ কমতে পারে।
৩. সামাজিক সুরক্ষা: কিছু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো হতে পারে।
৪. প্রশাসনিক ব্যয়: সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রশাসনিক ব্যয় কমানোর চেষ্টা করতে পারে।
৫. রাজ্য সরকারগুলোকে অনুদান: কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোকে দেওয়া অনুদান কিছুটা কমাতে পারে।
তবে এগুলো কেবল অনুমান। বাজেট ঘোষণার পর সঠিক তথ্য জানা যাবে। সরকার সাধারণত রাজস্ব ঘাটতি কমানো এবং পুঁজি ব্যয় বাড়ানোর লক্ষ্যে কিছু খাতে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে। তাই এবারের বাজেটেও এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে কিছু খাতে ব্যয় কমানো হতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট শুধু সংখ্যা ও পরিসংখ্যানের সমষ্টি নয়। এটি ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা। শিক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, কৃষি থেকে প্রযুক্তি – প্রতিটি খাতে এই বাজেটের প্রভাব পড়বে। মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের এই প্রথম বাজেট দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা দেখার জন্য সারা দেশ উন্মুখ হয়ে আছে। ২৩শে জুলাই যখন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বাজেট পেশ করবেন, তখন শুধু অর্থনীতিবিদরা নয়, সাধারণ মানুষও উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করবে জানতে – এই বাজেট তাদের জীবনে কী পরিবর্তন আনবে। আসুন আমরা সবাই মিলে অপেক্ষা করি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য, যখন ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের নতুন অধ্যায় শুরু হবে।
মন্তব্য করুন