অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের পর প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে ৫০ হাজার কোটি বাড়তি বরাদ্দ করছে মোদি সরকার

অপারেশন সিঁদুরের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা খাতকে আরও শক্তিশালী করতে অতিরিক্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে চলেছে মোদি সরকার। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত অর্থ…

Chanchal Sen

 

অপারেশন সিঁদুরের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা খাতকে আরও শক্তিশালী করতে অতিরিক্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে চলেছে মোদি সরকার। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে তা অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে।

এই বাড়তি বরাদ্দের ফলে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা দেশের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক হবে। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ইতিমধ্যেই ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৯.২ শতাংশ বেশি। এই অতিরিক্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয়ের কাজে ব্যবহৃত হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপারেশন সিঁদুরের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং স্বদেশী প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সাফল্য সরকারকে প্রতিরক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছে। গত ৬-৭ মে পাকিস্তানের জঙ্গি আস্তানাগুলিতে ভারত এই অভিযান চালিয়েছিল, যেখানে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছিল।

সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, অতিরিক্ত অর্থ প্রধানত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয়, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হবে। বিশেষ করে স্বদেশী প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির ওপর জোর দেওয়া হবে, যা অপারেশন সিঁদুরের সময় বিশেষভাবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ১২ মে তাঁর ভাষণে মেইড-ইন-ইন্ডিয়া প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সাফল্যের প্রশংসা করেছিলেন।

আসলে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিরক্ষা খাতে বিশেষ নজর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪-১৫ সালে প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ২.২৯ লক্ষ কোটি টাকা ছিল, যা এখন প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রতিরক্ষা বাজেট মোট কেন্দ্রীয় বাজেটের ১৩.৪৫ শতাংশ, যা সমস্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অপারেশন সিঁদুর ভারতের প্রতিরক্ষা দক্ষতা ও সক্ষমতার এক উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই অভিযানে ভারতের বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে স্বদেশীভাবে নির্মিত প্রযুক্তি, পাকিস্তানের পাঠানো প্রায় সমস্ত মিসাইল ও ড্রোন নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘ পাল্লার রাশিয়ান S-400 ‘ট্রায়াম্ফ’ সিস্টেম, বারাক-৮ মধ্যম পাল্লার SAM সিস্টেম এবং স্বদেশীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল পাকিস্তানি ড্রোন ও মিসাইল প্রতিরোধে।

অপারেশন সিঁদুরের পটভূমি ছিল গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলা, যাতে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক ছিলেন8। এরপর ভারত সীমানা অতিক্রম না করেই পাকিস্তানের জঙ্গি শিবিরগুলিতে মিসাইল হামলা চালায়। সেই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনয়ান-উন-মারসুস’ নামে পাল্টা হামলা চালালেও ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষা খাতে এই অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই পাস হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্ক বিবেচনায় রেখে প্রতিরক্ষা খাতে এই অতিরিক্ত বিনিয়োগ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিশেষ উল্লেখ্য, এবছর ফেব্রুয়ারিতে বাজেট উপস্থাপনের সময় প্রতিরক্ষা খাতে যে ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার মধ্যে ১.৮৫ লক্ষ কোটি টাকা ছিল ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বা মূলধনী ব্যয়ের জন্য, যা সরঞ্জাম অধিগ্রহণ ও আধুনিকীকরণের জন্য নির্ধারিত10। রাজস্ব বরাদ্দে সামরিক বাহিনীর জন্য ৩.১১ লক্ষ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের প্রায় ৪৫ শতাংশ নির্ধারিত করা হয়েছিল।

প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO)-এর জন্য বাজেটে ২৬,৮১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা আগের বছরের ২৩,৮৫৬ কোটি টাকা থেকে বেড়েছে। এর মধ্যে ১৪,৯২৪ কোটি টাকা মূলধনী ব্যয় এবং গবেষণা প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল, যেখানে মৌলিক গবেষণা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সাথে অংশীদারিত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।

সীমান্ত সড়ক সংগঠনের (Border Roads Organisation) জন্য ৭,১৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা সীমান্ত এলাকায় কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য, যেমন রাস্তা, টানেল এবং সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হবে। গত বছর থেকেই কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘আত্মনির্ভরতা’-র উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

২০২৪ সালে স্বদেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনের মূল্য রেকর্ড ১.২৬ লক্ষ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা রপ্তানি ২১,০৮৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে7। এই অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে টাটা এয়ারক্রাফ্ট কমপ্লেক্স এবং স্বদেশীয় প্ল্যাটফর্ম যেমন হালকা ট্যাঙ্ক ‘জোরাওয়ার’-এর প্রবর্তন উল্লেখযোগ্য।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ভারত তার প্রতিরক্ষা খরচের মাত্র ১ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৩ শতাংশ ব্যয় করে। এটি হাইপারসনিক অস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অগ্রগতিকে সীমিত করে। নতুন বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে এই ঘাটতি দূর করার চেষ্টা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পরিশেষে, অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের পর প্রতিরক্ষা খাতে এই অতিরিক্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত ভারতের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং স্বদেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী দিনে এই বিনিয়োগ ভারতকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।