রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাকে “মহৎ মিশন” আখ্যা দিয়ে তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। গত কয়েক মাস ধরে ভারতের নিরলস কূটনৈতিক উদ্যোগ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি আলোচনায় মধ্যস্থতা এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি দিলেন পুতিন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, “যুদ্ধবিরতি শুধু অস্থায়ী নয়, টেকসই শান্তি ও সংকটের মূল কারণ দূর করতেই আমাদের সমাধান চাই”।
মোদীর শান্তি মিশন ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
২০২৪ সালের জুলাইয়ে মস্কোতে ভারত-রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে মোদী সরাসরি পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর আগস্টে কিয়েভ সফরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন তিনি। উভয় বৈঠকেই মোদী স্পষ্ট করেন, “যুদ্ধের যুগ নয়, আলোচনার টেবিলেই সমাধান সম্ভব”। গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “ভারত নিরপেক্ষ নয়, আমরা শান্তির পক্ষে”। এই বক্তব্য ইউক্রেনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি দূর করে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন চুক্তি ও রাশিয়ার শর্ত
সৌদি আরবের জেদ্দায় মার্কিন-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার পর কিয়েভ ৩০ দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। পুতিন এই প্রস্তাবে সম্মতির ইঙ্গিত দিলেও শর্ত যুক্ত করেন: কোনো সমাধানই যেন সংকটের মূল কারণ উপেক্ষা না করে। রাশিয়ার দাবি, ন্যাটো সম্প্রসারণবিরোধী নিশ্চয়তা ও ডনবাস অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। পুতিনের মতে, ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্তে মার্কিন চাপের প্রভাব থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতিই তাদের বাধ্য করেছে।
ভারতের মধ্যস্থতায় বিশ্বের আস্থা
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক গোপন বৈঠকে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা মোদীকে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিয়েভের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলেও রাশিয়ার উপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। এমনকি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানও মোদীর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বিবরণ শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, “রাশিয়ার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে ভারত সক্ষম”।
যুদ্ধবিরতির পথে চ্যালেঞ্জ
যদিও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবনা ইতিবাচক, শান্তি আলোচনার রূপরেখা এখনও অস্পষ্ট। রাশিয়া দখলকৃত অঞ্চলগুলোর আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি চাইলে ইউক্রেন তাতে আপোস করতে নারাজ। এমন প্রেক্ষাপটে মোদীর কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করা হয়েছে। গত বছর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মস্কো ও কিয়েভে একাধিকবার আলোচনা চালিয়েছেন। পুতিন স্বীকার করেন, ভারতের প্রতি রাশিয়ার আস্থা রয়েছে বলেই মোদীর মধ্যস্থতা গ্রহণযোগ্য।
পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের ভারসাম্য
প্রাথমিকভাবে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে মোদীর আন্তরিক সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান ছিল। বিশেষত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে মস্কো সফরকালে পুতিনের সঙ্গে মোদীর আত্মীয়তাপূর্ণ আচরণ কিয়েভে সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে ইউক্রেন সফরে গিয়ে জেলেনস্কিকে সমর্থন ও মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করেন মোদী। ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবনা প্রকাশ্যে সমর্থন করলেও ভারত কখনই সরাসরি রাশিয়াকে নিন্দা করেনি, বরং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারাও এই সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখলেও ভারতের অবস্থান অনন্য। সুইৎজারল্যান্ড বা সৌদি আরবের মতো অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের তুলনায় ভারতের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক একে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। পুতিনের ভাষ্যমতে, “প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে। তবুও ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতারা সময় বের করে এই মহৎ কাজে এগিয়ে এসেছেন”।
শান্তির আশাবাদ
বর্তমান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবনা স্থায়ী সমাধানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। মোদীর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে ফুটে উঠেছে সতর্ক আশাবাদ: “আলোচনা টেবিলেই শুধু শান্তি সম্ভব, রণক্ষেত্রে নয়”। বিশ্বজুড়ে কূটনীতিবিদদের মতে, ভারতের বহুমুখী কৌশল ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তিই তাকে এই সংকটে অনন্য মধ্যস্থতাকারী করে তুলেছে। ইউক্রেন সংকট সমাধানে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে ভারতের এই ভূমিকা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার প্রভাব আরও সুদৃঢ় করবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।