এশিয়ার ফুটবল মঞ্চে দর্শক টানার ক্ষেত্রে শীর্ষে উঠে এসেছে ভারতের দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দর্শকসংখ্যার নিরিখে এশিয়ার প্রথম পাঁচ ক্লাবের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে মোহনবাগান, আর ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) তাদের পাশাপাশি চমক দেখিয়েছে ইস্টবেঙ্গলও। এই দুই কলকাতার ক্লাবের জনপ্রিয়তা শুধু ভারতেই নয়, গোটা এশিয়া মহাদেশে ফুটবলপ্রেমীদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এই সংবাদটি ফুটবল ভক্তদের কাছে উৎসাহের একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে।
মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় ফুটবলের প্রাণ। মোহনবাগান, যিনি বর্তমানে আইএসএলে ‘মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট’ নামে পরিচিত, তাদের ঘরের মাঠ সল্টলেক স্টেডিয়ামে প্রতি ম্যাচে গড়ে হাজার হাজার দর্শক টানছে। এই মরসুমে তাদের দর্শকসংখ্যা এতটাই বেশি যে, এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ ক্লাবের তালিকায় তারা স্থান করে নিয়েছে। অন্যদিকে, ইস্টবেঙ্গলও পিছিয়ে নেই। লাল-হলুদ ব্রিগেড তাদের ম্যাচে দর্শকদের উৎসাহ এবং সমর্থনের দিক থেকে আইএসএলে একটি উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখিয়েছে। বিশেষ করে কলকাতা ডার্বির সময় দুই দলের সমর্থকদের উন্মাদনা স্টেডিয়ামকে একটি উৎসবের মতো করে তুলেছে। এই মরসুমে দুই দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে দর্শকসংখ্যা রেকর্ড গড়েছে, যা তাদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
এই জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে দুই ক্লাবের ঐতিহাসিক সাফল্য এবং সমর্থকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। মোহনবাগান ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এশিয়ার প্রাচীনতম ক্লাবগুলোর একটি। ১৯১১ সালে তারা প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে আইএফএ শিল্ড জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এরপর থেকে তারা একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছে। আইএসএলে এসেও তারা তাদের দাপট বজায় রেখেছে। গত দুই মরসুমে তারা লিগ শিল্ড জিতে প্রমাণ করেছে যে তারা শুধু দর্শকদের মনই নয়, মাঠের খেলাতেও শ্রেষ্ঠ। ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি কলকাতা ফুটবল লিগে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং সমর্থকদের কাছে ‘লাল-হলুদ’ নামে একটি আবেগের প্রতীক। আইএসএলে তাদের যাত্রা শুরুতে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও, এখন তারা দর্শকদের উপস্থিতি দিয়ে নিজেদের শক্তি দেখাচ্ছে।
এই দুই ক্লাবের দর্শকসংখ্যা শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি তাদের সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের প্রতিফলন। মোহনবাগানের সমর্থকরা, যারা ‘মেরিনার্স’ নামে পরিচিত, প্রতিটি ম্যাচে সবুজ-মেরুন রঙে স্টেডিয়াম ভরিয়ে দেয়। তাদের চিৎকার, গান এবং উৎসাহ মাঠে একটি অনন্য পরিবেশ তৈরি করে। একইভাবে, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা লাল-হলুদ পতাকা নিয়ে মাঠে উপস্থিত হয়ে দলকে উৎসাহ দেয়। এই দুই ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা কলকাতা ডার্বি নামে বিখ্যাত, ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। গত মরসুমে আইএসএলের একটি ডার্বি ম্যাচে প্রায় ৬০ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন, যা এশিয়ার অন্যান্য শীর্ষ ক্লাবের তুলনায় অনেক বেশি। এই দর্শকসংখ্যা এশিয়ার ফুটবল ক্লাবগুলোর মধ্যে তাদের অবস্থানকে মজবুত করেছে।
মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের এই জনপ্রিয়তা তাদের সমর্থকদের ভালোবাসার ফসল। এই দুই দলের ম্যাচে শুধু খেলা দেখতে আসে না মানুষ, তারা তাদের আবেগ আর উৎসাহ নিয়ে আসে। মোহনবাগান যখন মাঠে নামে, তখন স্টেডিয়ামে একটা ঢেউ ওঠে। ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচেও একই দৃশ্য। এই মরসুমে আইএসএলে মোহনবাগানের গড় দর্শকসংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজারের কাছাকাছি, যেখানে ইস্টবেঙ্গলেরও ২৫ হাজারের বেশি দর্শক প্রতি ম্যাচে হাজির হচ্ছে। এই সংখ্যা এশিয়ার অনেক বড় লিগের ক্লাবের তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ, চীন বা জাপানের কিছু ক্লাবের দর্শকসংখ্যা এর কাছাকাছি হলেও, কলকাতার এই দুই দলের সমর্থকদের উন্মাদনা একেবারে আলাদা।
এই সাফল্যের পেছনে আইএসএলের ভূমিকাও কম নয়। ভারতীয় ফুটবলকে আধুনিক রূপ দিতে আইএসএল যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, তাতে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবগুলো নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আইএসএল শুরুর আগে এই দুই দল কলকাতা লিগ এবং জাতীয় ফুটবল লিগে খেললেও, এখন তারা দেশের বাইরেও পরিচিতি পাচ্ছে। মোহনবাগানের গত দুই মরসুমের শিল্ড জয় এবং ইস্টবেঙ্গলের ধীরে ধীরে উন্নতি তাদের সমর্থকদের আরও উৎসাহিত করেছে। ফুটবল বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই ক্লাবের দর্শকসংখ্যা এশিয়ার ফুটবল মানচিত্রে ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল শুধু ক্লাব নয়, এরা ভারতীয় ফুটবলের গর্ব। তাদের দর্শকসংখ্যা এশিয়ার প্রথম পাঁচে থাকা এবং আইএসএলে চমক দেখানো প্রমাণ করে যে, কলকাতার ফুটবল সংস্কৃতি এখনও জীবন্ত। এই দুই দলের সমর্থকদের ভালোবাসা এবং উৎসাহই তাদের এই জায়গায় এনেছে। ভবিষ্যতে এই জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন ফুটবলপ্রেমীরা।