পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূমে অণ্ডকোষের হাইড্রোসিল রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে পুরুলিয়ায় ৩১৭৪ জন, পশ্চিম বর্ধমানে ১১৫৫ জন এবং বীরভূমে ৯৮০ জন হাইড্রোসিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এসবের জন্য দায়ী রয়েছে স্ত্রী কিউলেক্স মশার কামড়ে ছড়ানো লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস নামক পরজীবী সংক্রমণ, যা মানব শরীরের লসিকা তন্ত্রকে আক্রমণ করে অণ্ডকোষে তরল জমাট বাঁধায়।
লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, যা সাধারণভাবে “হাতিপাও” নামেও পরিচিত, একটি গুরুতর অক্ষমতাজনক রোগ। এই রোগ মূলত কিউলেক্স মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়, যা নোংরা ও দূষিত জলে বংশবৃদ্ধি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে এই রোগ অণ্ডকোষে জল জমা হওয়া, পা ফোলা, লিম্ফোডিমা এবং কুঁচকি, হাত ও পায়ের কিছু অংশ লাল হয়ে ফুলে ওঠার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাংলায় নিযুক্ত ‘নেগলেক্টেড ট্রপিকাল ডিজিজ’ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোর্ডিনেটর ডা. প্রীতম রায় জানিয়েছেন, “পৃথিবীব্যাপী তিন ধরনের ফাইলেরিয়াসিস রয়েছে। এর মধ্যে বাংলায় অধিকাংশ আক্রান্ত লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস-এ। এই লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস থেকেই কারও শরীরে বাসা বাঁধে লিম্ফোডিমা (পা ফুলে যাওয়া)। কারও বা হাইড্রোসিল।”
সংক্রমণের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ নিশান্তদেব ঘটকের মতে, যখন একটি সংক্রমিত কিউলেক্স মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন মশার শরীরে থাকা পরজীবীর লার্ভা বা মাইক্রোফাইলেরিয়া সেই ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে00l। এই পরজীবী রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশেষ করে কুঁচকি, হাত, পা, অণ্ডকোষ ও মহিলাদের স্তনের লসিকা গ্রন্থিতে বাসা বাঁধে।
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতের সব এনডেমিক জেলা থেকে ৬.১৯ লক্ষ লিম্ফোডিমা এবং ১.২৭ লক্ষ হাইড্রোসিল রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী ৬৫৭ মিলিয়ন মানুষ এখনও এই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফাইলেরিয়াল হাইড্রোসিল একটি গুরুতর সমস্যা যা শুধু শারীরিক ব্যথা ও অস্বস্তি নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উত্তর প্রদেশের ৪২ বছর বয়সী কৃষক নরেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই রোগে অণ্ডকোষে ক্রমাগত ভারী ও অস্বস্তিকর ফোলা দেখা দেয়, যা সামাজিক কলঙ্ক এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ডা. ভূপেন্দ্র ত্রিপাঠী, ইনফেকশাস ডিজিজ এবং ভ্যাকসিন ডেলিভারির ডেপুটি ডিরেক্টর, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, জানিয়েছেন, “যদিও হাইড্রোসিল সাধারণত ব্যথাহীন ফোলা হিসেবে দেখা দেয়, এটি চলাফেরা ও জীবিকার উপর দূরগামী প্রভাব ফেলতে পারে। এই রোগ যৌন অক্ষমতা, প্রজনন সমস্যা এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের মতো অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।”
এই রোগের প্রতিকারে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল সার্জারি বা অপারেশন। বর্তমানে ব্যবহৃত ঔষধগুলি যেমন ডিইসি বা আইভারমেকটিন এবং অ্যালবেনডাজোল প্রাপ্তবয়স্ক কৃমির উপর কাজ করে না, ফলে হাইড্রোসিল রোগের উপর কোনো উপশমকারী প্রভাব ফেলে না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত লসিকা তন্ত্রের যান্ত্রিক অবরোধের জন্য যে সংক্রমণ, প্রদাহ এবং তরল জমার কারণ হয়, সেগুলি থেকে মুক্তি পেতে সার্জারি সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সমস্ত জানালা বন্ধ রাখা, মশারি ব্যবহার করা, বা বিকল্পভাবে উন্মুক্ত স্থানে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা। আশপাশে বদ্ধ জল না রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ধরানো জলাশয়গুলি মশার প্রজনন ক্ষেত্র। আক্রান্ত স্থানে থাকাকালীন, বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত, হাত ও পা অনাবৃত না রাখা এবং লম্বা হাতা সহ পোশাক, পূর্ণ দৈর্ঘ্যের প্যান্ট এবং মোজা পরা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার “গ্লোবাল প্রোগ্রাম টু এলিমিনেট লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস” (GPELF) এর দুটি মূল লক্ষ্য রয়েছে: মাইক্রোফাইলারিসাইডস ওষুধ ব্যবহার করে ম্যাস ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমডিএ) প্রোগ্রামের মাধ্যমে সংক্রমণ বন্ধ করা এবং ফাইলেরিয়াল হাইড্রোসিল সহ দীর্ঘস্থায়ী রোগ সম্পর্কিত রুগ্নতা কমানো।
ভারতসহ বাংলায় লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস দমনে প্রচারাভিযান চলছে। সার্বিক জনসচেতনতা, প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমেই এই রোগের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।