Muhammad Yunus to take oath as head of interim government today: মুহাম্মদ ইউনুস, যাকে শেখ হাসিনা একসময় ‘গরিবদের রক্তচোষা’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনিই এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। গত সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর থেকে চলমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন।৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ইউনুস বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। তিনি বুধবার প্যারিস থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
মুহাম্মদ ইউনুস ও শেখ হাসিনার মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইউনুস একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা গৃহবন্দি বা কারাবন্দি ছিলেন।২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে হাসিনা সরকার ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করেন।
Bangladesh Crisis: গণবিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, কেন শেখ হাসিনার পতন?
হাসিনা তখন অভিযোগ করেন যে, গ্রামীণ ব্যাংক “গরিবদের রক্ত চুষে খাচ্ছে” এবং ইউনুস এই প্রতিষ্ঠানকে তার “ব্যক্তিগত সম্পত্তি” হিসেবে ব্যবহার করছেন।ইউনুস নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “তারা আমাকে সরিয়ে দিল কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমার প্রতিস্থাপন খুঁজে পায়নি… এই ব্যাংকের ৯৭% মালিকানা গরিব মানুষের এবং সরকারের মালিকানা মাত্র ৩%।”এরপর থেকে ইউনুস নানা আইনি জটিলতার সম্মুখীন হন। ২০১৩ সালে তাকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।
তিনি যে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলির বিরুদ্ধেও আর্থিক তদন্ত শুরু করা হয়।চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউনুসকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও মার্চে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরও ১০০টিরও বেশি মামলা চলমান রয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে চলমান ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে। প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পরবর্তীতে ব্যাপক গণবিক্ষোভে রূপ নেয়।আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিক্ষোভ হিংসাত্মক রূপ নেয় যখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যরা পুলিশের সহায়তায় রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়।সরকার দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয় এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
শেখ হাসিনার পতন: গণবিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
জুলাই ১০ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে সহিংসতা ও সরকারি দমনে অন্তত ১৮৭ জন নিহত হন এবং প্রায় ১,০০০ জন গ্রেফতার হন।জুলাই ২১ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট অধিকাংশ চাকরি কোটা বাতিল করে দেয়, যার ফলে পূর্বে নির্ধারিত ৩০% কোটা কমিয়ে মাত্র ৫% করা হয়। এর সাথে জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ২% কোটা রাখা হয়, বাকি ৯৩% পদ যোগ্যতার ভিত্তিতে পূরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।কিন্তু এই সিদ্ধান্তেও বিক্ষোভ থামেনি।
জুলাই ২৯ তারিখ থেকে আবার বিক্ষোভ শুরু হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি ওঠে। অগাস্ট ৪ তারিখে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১০০ জন নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।অবশেষে অগাস্ট ৫ তারিখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং হেলিকপ্টারে করে দেশ ত্যাগ করেন। পরে তিনি ভারতের দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। সূত্র অনুযায়ী, হাসিনা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছেন। তার বোন রেহানা, যিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক, তার সঙ্গে রয়েছেন।
মুহাম্মদ ইউনুস এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে হিংসাত্মক বিক্ষোভের একটি সময়ে দেশের নেতৃত্ব নিচ্ছেন। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা।পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও সাবেক বিশ্বব্যাংক অর্থনীতিবিদ আহমেদ আহসান মনে করেন, “ইউনুস হলেন সেই ব্যক্তি যাকে ছাত্ররা বেছে নিয়েছে, যারা এই আন্দোলন পরিচালনা করেছে। তিনি দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত।”তবে ইউনুসের সামনে অনেক বাধা রয়েছে। পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট ডেভিড ডানিলোউইচ মনে করেন, “নতুন সরকারকে ভারতের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, কারণ ভারতের বিরোধিতা বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।”এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভালো নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২% ছিল, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। মুদ্রাস্ফীতি ৯% এর কাছাকাছি রয়েছে।
ইউনুস বুধবার প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমানবন্দর থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি দেশে ফিরে যেতে উদ্বিগ্ন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এবং আমাদের সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় কীভাবে নিজেদের সংগঠিত করতে পারি তা দেখতে চাই।”তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমি সবাইকে অনুরোধ করছি শান্ত থাকতে। দয়া করে কোনো ধরনের সহিংসতা করবেন না।”সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে জানিয়েছেন, হাসিনার পদত্যাগের পর যারা অশান্তি সৃষ্টি করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, ইউনুসের নেতৃত্বে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
ইউনুসের প্রথম কর্মপরিকল্পনা
মুহাম্মদ ইউনুস বৃহস্পতিবার রাতে শপথ গ্রহণের পর তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন:
সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহযোগিতায় দ্রুত দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা হবে। সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং বিনিয়োগ বাড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে।
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে যাতে আগামী ৬ মাসের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যায়।
সরকারি কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হবে এবং বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হবে।
ইউনুস বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো একটি সুশাসিত, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আমি সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা কামনা করছি।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইউনুসের ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে:
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নতি আশা করছি।”
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে আশা করছি।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন দেখে আশাবাদী। জাতিসংঘ নতুন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।”
ইইউ’র হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেল বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। তবে আমরা আশা করি নতুন সরকার চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে।”
সম্ভাব্য প্রভাব
মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা বলেন, “ইউনুস একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। তিনি সব দলের সাথে সমান দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারেন। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, “ইউনুসের অর্থনৈতিক দর্শন মাইক্রোক্রেডিটের বাইরেও বিস্তৃত। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “ইউনুসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করবে। এটি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে।”
সমাজবিজ্ঞানী ড. বিনায়ক সেন মনে করেন, “ইউনুসের সামাজিক উদ্যোক্তা মডেল বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও নারী ক্ষমতায়নে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহফুজ আনাম সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “ইউনুসের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। এগুলো তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে।”
মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। তার সামনে রয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ – দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা। তবে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও অভিজ্ঞতা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের জনগণ এখন আশা করছে যে, ইউনুসের নেতৃত্বে দেশ একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে এই পথ সহজ হবে না। সফলতা নির্ভর করবে সব পক্ষের সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ইউনুসের নেতৃত্ব দক্ষতা ও তার সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর। আগামী কয়েক মাস হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা নির্ধারণ করবে দেশটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের গতিপথ।