Mujib and India’s friendship: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের একটি বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার সমন্বয়, যা উভয় দেশের জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধনের সৃষ্টি করেছিল।বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী “ইন্দো-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামেও পরিচিত। চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, “আমাদের ভারতের সাথে একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হবে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে ব্যাপক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় প্রদান করেছিল। ১৯৭১ সালে ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করে, যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।স্বাধীনতার পর নবগঠিত বাংলাদেশকে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি মৌলিক নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে। উভয় দেশই উদার ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ করে।১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী একটি আনুষ্ঠানিক সফর করেন। এই সফরের সময় দুই দেশ মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
শেখ হাসিনার পতন: বাংলাদেশের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
তবে, মুজিবের শাসনামলে কিছু সমস্যাও দেখা দেয়। তিনি বিরোধী দলগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন, তাঁর দলের সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে পারেননি এবং নিজের ইসলামী পরিচয় বাড়ানোর জন্য ইসলামী প্রতীক ব্যবহার শুরু করেন। এসব কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা প্রভাব পড়ে।মুজিব নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে চেষ্টা করেন, কারণ তাকে ভারতের একজন বড় মিত্র হিসেবে দেখা হত। তিনি নিজের ব্যর্থতার জন্য ভারতকে দোষারোপ করা শুরু করেন, যদিও এসব ব্যর্থতা তাঁর সরকারের কুশাসনের কারণে ঘটেছিল। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য বাকশাল গঠনের প্রবণতাও দেশে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনায় ভারত তীব্র সমালোচনা করে। এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যায়। মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যারা বাংলাদেশের সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। এর মধ্যে সৌদি আরব ও চীন উল্লেখযোগ্য।এই সময়ে বাংলাদেশকে সমালোচনা করা হয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে, যেমন আসাম এর ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা), তাদের ভূখণ্ডে ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দেওয়ার জন্য। অন্যদিকে, বাংলাদেশ অভিযোগ করে যে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী বিদ্রোহকে সমর্থন করছে।
১৯৯৭ সালে যখন চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় এলো, তখন দুই দেশের সরকারই চুক্তিটি পুনর্নবীকরণ বা পুনঃআলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের একটি যুগের অবসান ঘটে।তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আবার উন্নতির দিকে এগিয়েছে। যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য ও বাণিজ্য, স্বাস্থ্য এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই অগ্রগতির পথে ভারত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।স্থল সীমানা ও সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হয়েছে। ভারতের সকল রাজনৈতিক দল ও সংসদ সদস্যদের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে স্থল সীমানা চুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থনের মতোই ঐতিহাসিক।বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরেকটি উজ্জ্বল দিক। গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে।
এছাড়াও নবায়নযোগ্য শক্তি, অফশোর অন্বেষণ, এলএনজি, এলপিজি, ডিজেলসহ বিভিন্ন শক্তি খাতে দুই দেশ সহযোগিতা করছে। ভুটান ও নেপালে হাইড্রো-পাওয়ার প্রকল্প যৌথভাবে উন্নয়ন ও ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনাও রয়েছে।পানি সম্পদের ক্ষেত্রে, দুই দেশই বিশ্বাস করে যে সাধারণ জলসম্পদ একতার শক্তি হিসেবে কাজ করা উচিত। সকল সাধারণ নদীর পানি বণ্টনের সমাধানসহ একটি ব্যাপক, বেসিন-ভিত্তিক সমাধান দুই দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
এছাড়া ফেনী, গুমতি, মনু, খোয়াই, গঙ্গা, দুধকুমার ও রাশিদপুর খালের পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা চলছে।বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে একটি। ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার দিয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।যোগাযোগ খাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বেড়েছে। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস, ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা কন্টেইনার ও পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিস, কলকাতা-খুলনা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারতকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আকাশপথে যোগাযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে।সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিয়মিত বিনিময় কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতীয় নাগরিকদের সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারত সরকার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে যৌথ গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।স্বাস্থ্য খাতেও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় ভারত বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহ করেছে। এছাড়া চিকিৎসা সেবা, ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে দুই দেশ একসাথে কাজ করছে।তবে, এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা দুই দেশকে মোকাবেলা করতে হবে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, অবৈধ অভিবাসন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। তবে উভয় দেশই এসব সমস্যা সমাধানে আন্তরিক।সামগ্রিকভাবে, মুজিব-ইন্দিরা বন্ধুত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বর্তমানে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, সহযোগিতা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে বলে আশা করা যায়।বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ।