হুরুন গ্লোবাল রিচ লিস্ট ২০২৫ অনুসারে, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা কমে গেছে, যা মূলত কোম্পানির বর্ধিত ঋণের কারণে ঘটেছে। তবে এতেও তিনি এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অবস্থান ধরে রেখেছেন।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের হিসেবে টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী এলন মাস্ক তাঁর অবস্থান বজায় রেখেছেন। মাস্কের সম্পদের পরিমাণ বিস্ময়করভাবে ৮২% বৃদ্ধি পেয়ে ৪২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা তাঁকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করা ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্কের এই সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে টেসলার শেয়ার মূল্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং তথাকথিত “ট্রাম্প প্রভাব” অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে বেশ কিছু মার্কিন ধনকুবেরের সম্পদও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের তালিকায় রয়েছেন – এলন মাস্ক (৩৫৮.৫ বিলিয়ন ডলার), মার্ক জাকারবার্গ (২৩৩.৩ বিলিয়ন ডলার), জেফ বেজোস (২২৯.৮ বিলিয়ন ডলার), ল্যারি এলিসন (২১০.৫ বিলিয়ন ডলার), বার্নার্ড আর্নল্ট ও পরিবার (১৮৭.৬ বিলিয়ন ডলার), ওয়ারেন বাফেট (১৫৬.৫ বিলিয়ন ডলার), ল্যারি পেজ (১৪২.৭ বিলিয়ন ডলার), সের্গেই ব্রিন (১৩৬.৫ বিলিয়ন ডলার), আমানসিও ওর্টেগা (১২২.১ বিলিয়ন ডলার) এবং স্টিভ বলমার (১১৯.৪ বিলিয়ন ডলার)।
এই তালিকা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের মধ্যে ৯ জনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, শুধুমাত্র ফ্রান্সের বার্নার্ড আর্নল্ট (এলভিএমএইচ) ব্যতিক্রম। এছাড়া বেশিরভাগই প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা, যা প্রযুক্তি শিল্পের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও একবার প্রমাণ করে6।
ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে, মুকেশ আম্বানি ৮.৬ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অবস্থান বজায় রেখেছেন। অন্যদিকে, গৌতম আদানির সম্পদ ১৩% বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৪ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আদানির এই অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য, কারণ হুরুন গ্লোবাল রিচ লিস্ট ২০২৫-এ তিনি ভারতের সর্বাধিক সম্পদ বৃদ্ধিকারী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ক্রমাগত সম্প্রসারণকে প্রতিফলিত করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এই তালিকায় আরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো এইচসিএল টেকনোলজিসের চেয়ারপার্সন রোশনি নাদার, যিনি ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৩.৫ লক্ষ কোটি টাকা। বিশেষ উল্লেখ্য, তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ মহিলার তালিকায় প্রবেশ করেছেন। তাঁর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে তাঁর পিতা শিব নাদার এইচসিএলের ৪৭% শেয়ার তাঁর কাছে হস্তান্তর করার পর।
আম্বানির সম্পদ হ্রাসের পেছনে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের শক্তি ও খুচরা বিক্রয় খাতে পড়তি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করা হয়েছে। কোম্পানিটি এখন বিক্রয় বৃদ্ধির সমস্যা এবং ঋণের চাপের মুখোমুখি, সেইসাথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং খুচরা বিক্রয় খাত সম্প্রসারণের জন্য রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে মাস্কের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি তাঁর সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। তালিকার কাট-অফ ডেট (জানুয়ারি ২০২৫) থেকে মাস্কের সম্পদ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার কমেছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে টেসলার মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনে তীব্র পতন দেখা গেছে, যা চীনা ইলেকট্রিক ভেহিকল নির্মাতাদের সাথে বর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং মাস্কের বিতর্কিত রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধনকুবেরদের আবাসস্থল হিসেবে নিজের অবস্থান আরও মজবুত করেছে। হুরুন গ্লোবাল রিচ লিস্টের মতে, ভারতে এখন ২৮৪ বিলিয়নেয়ার রয়েছেন, যেখানে এই বছর ১৩ জন নতুন নাম যুক্ত হয়েছে। ভারতীয় ধনকুবেরদের মোট সম্পদের পরিমাণ এখন ৯৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভারতের জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং সৌদি আরবের সমগ্র অর্থনীতির চেয়েও বেশি।
মুম্বাই ৯০ জন ধনকুবের নিয়ে ভারতের ধনকুবের রাজধানী হিসেবে রয়েই গেছে। তবে এশিয়ার ধনকুবের কেন্দ্র হিসেবে তার অবস্থান শাংহাইয়ের কাছে হারিয়েছে, যেখানে এখন ৯২ জন ধনকুবের রয়েছেন।
সামগ্রিকভাবে, বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় প্রযুক্তি খাতের প্রভাব স্পষ্ট। টেসলা, মেটা, অ্যামাজন, অর্যাকল, মাইক্রোসফট, গুগল – এই প্রতিষ্ঠানগুলির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরাই বিশ্বের সর্বাধিক ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছেন। ভারতীয় ধনকুবেরদের ক্ষেত্রে, শিল্প, তেল ও গ্যাস, বন্দর, বিমানবন্দর, খনন, নবায়নযোগ্য শক্তি, মিডিয়া এবং সিমেন্ট সহ বিভিন্ন খাতে বিস্তৃত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে।
এই জাতীয় ধন-সম্পদের ওঠানামা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি বৈশ্বিক বাজারের গতিশীলতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন শিল্পের উত্থান-পতনকেও প্রতিফলিত করে। ২০২৫ সালে বিশ্বের ধনকুবেরদের সম্পদের পরিবর্তন আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।