আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রথম বার্ষিকীতে শনিবার (৯ আগস্ট ২০২৫) দুপুর ১২টায় শুরু হয়েছে নবান্ন অভিযান। নিহত চিকিৎসকের মা-বাবার ডাকে এই অরাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। অভিযান ঠেকাতে কলকাতা ও হাওড়া পুলিশ ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। দুই মানুষ সমান উঁচু লোহার ব্যারিকেড, জলকামান ও হাজার হাজার পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এর পাশাপাশি হাওড়া ব্রিজ ও দ্বিতীয় হুগলি সেতু বন্ধ করে দেওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
গত বছর ৯ আগস্ট রাতে আরজি কর হাসপাতালে কর্মরত একজন তরুণী পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক ধর্ষিত ও নিহত হন। এই ঘটনার তদন্তভার বর্তমানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। কিন্তু একবছর পরেও ন্যায়বিচার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ নির্যাতিতার পরিবার। নিহত চিকিৎসকের বাবা বলেছেন, “তৃণমূল বলছে অভয়া নাকি বিচার পেয়ে গেছে, তাহলে কেন আন্দোলন করছি আমরা। তাঁদের উদ্দেশে একটাই কথা, যত ব্যারিকেড করুন আমরা নবান্নে পৌঁছে যাব”।
ছাত্র জনতার নবান্ন অভিযানে সকাল থেকেই মারমুখী উভয় পক্ষই
নবান্ন অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে পুলিশ অভূতপূর্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। হাওড়ার সাঁতরাগাছি, ফোরশোর রোডের বাঁশতলা মোড়, জিটি রোড লাগোয়া হাওড়া ময়দানসহ গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে লোহার বিম ঢালাই করে ১০ ফুট উঁচু গার্ডরেল বসানো হয়েছে। এছাড়াও মল্লিক ফটক, কাজীপাড়া, বেতাই তলাসহ আরও বেশ কিছু জায়গায় বাঁশ ও লোহার তৈরি অতিরিক্ত ব্যারিকেড স্থাপন করা হয়েছে। সাঁতরাগাছিতে তৈরি করা হয়েছে একটি অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম।
কলকাতার দিকে এজেসি বসু রোডে টার্ফ ভিউয়ের সামনে, হেস্টিংস মোড়, খিদিরপুর ১১ ফার্লং গেট এবং হাওড়া সেতুতে স্টিলের ব্যারিকেড, কন্টেনার এবং জলকামান বসানো হয়েছে। বিদ্যাসাগর সেতুর মুখেও ব্যারিকেড বসানো হয়েছে যাতে কোনও মিছিল সেতুতে উঠতে না পারে। শহরের মোট ১৯টি জায়গায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
হাওড়া ও কলকাতার মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হাওড়া ব্রিজ এবং দ্বিতীয় হুগলি সেতু মিছিল শুরুর এক ঘন্টা আগে থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অফিস টাইমে সাধারণ মানুষদের চূড়ান্ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অনেক যাত্রী পায়ে হেঁটে নদী পার হতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে বিকল্প পথের নির্দেশনা দেওয়া হলেও তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে।
পুলিশের মতে, এই নবান্ন অভিযানের জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেওয়া হয়নি। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম জানিয়েছেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নবান্ন অভিযানের কথা জানা গিয়েছে কিন্তু কেউ পুলিশের কাছে অনুমতি চাননি। ‘নবান্ন’ সংলগ্ন এলাকায় ভারতীয় ন্যায়বিধি সঙ্কলন (BNSS)-এর ধারা ১৬৩ অনুসারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে পুলিশ হাওড়ার সাঁতরাগাছি বাস স্ট্যান্ড ও কলকাতার রানি রাসমণি রোডে জমায়েতের অনুমতি দিয়েছে।
নবান্ন অভিযানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অংশগ্রহণ করবেন বলে জানা গিয়েছে। তবে এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন হওয়ায় তিনি দলীয় পতাকা ছাড়াই মিছিলে হাঁটবেন। ডোরিনা ক্রসিং থেকে অভয়ার মা-বাবার সঙ্গে এই মিছিলে যোগ দেবেন বিজেপির কর্মী সমর্থকরা, তবে তাদের সাথে থাকবে শুধুমাত্র জাতীয় পতাকা, কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা নয়।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে হাওড়ায় দুই হাজারের বেশি পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। রয়েছেন চার জন এডিজি পদমর্যাদার পুলিশ অফিসার, ১৩ জন ডিআইজি এবং ১৫ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আধিকারিক। প্রস্তুত রাখা হয়েছে চারটি জলকামান। কলকাতায় ২৫ জন উপ-নগরপাল পদমর্যাদার অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিবাদীদের মিছিল আটকাতে। পাঁচ জায়গায় মোতায়েন থাকবে কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনী এবং নজরদারি চলবে ড্রোনের মাধ্যমেও।
তিনটি প্রধান পথ থেকে নবান্নের দিকে মিছিল রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে। শিয়ালদহ থেকে একটি মিছিল, ডোরিনা ক্রসিং থেকে আরেকটি মিছিল যেখানে নির্যাতিতার মা-বাবা থাকবেন এবং হাওড়ার সাঁতরাগাছি থেকে তৃতীয় মিছিল। বাইরের জেলা থেকেও প্রায় ১৫০০ জন পুলিশ কর্মীকে নিয়ে আসা হয়েছে অভিযান মোকাবেলার জন্য।
অভয়ার মা অভিযানের আগে বলেছেন, “আজও প্রতিরাতে মেয়ের কান্না শুনতে পাই।” তিনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে ‘অপদার্থ’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, “তদন্তের নামে সার্কাস চলছে। তথ্য প্রমাণ লোপাট করেছে কলকাতা পুলিশ”। অভয়ার বাবাও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন যে তার মেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির শিকার এবং প্রশাসন, কলেজ কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য দপ্তর সকলেই এর জন্য দায়ী।
কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নবান্ন অভিযানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। তবে আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হতে হবে এবং পুলিশ, সরকারি কর্তৃপক্ষ বা সরকারি সম্পত্তির কোনও ক্ষতি করা যাবে না। এই আইনি অনুমোদন পেয়ে নির্যাতিতার পরিবার আরও দৃঢ়ভাবে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরজি কর কাণ্ডে মমতার পদত্যাগ দাবি: বিজেপির ‘এক দফা, এক দাবি’ আন্দোলন
পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি সত্ত্বেও বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে। দুর্গাপুর থেকে দলে দলে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও অসংখ্য মানুষ কলকাতামুখী হয়েছেন অভিযানে যোগ দিতে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেশী ও বাজারের মানুষদের আচরণ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভয়ার বাবা। তিনি বলেছেন, “রাস্তায় দেখা হলেও প্রতিবেশীরা কথা বলেন না। বাজারে কোনও জিনিস কিনতে গেলে বিক্রেতা দশবার ভাবেন বিক্রি করবেন কিনা! এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস”। পারিবারিক এই বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক অস্বস্তির কথা তুলে ধরে তিনি রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
নবান্ন অভিযানের এই দিনে আজ ইউজিসির নেট পরীক্ষাও রয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য প্রশাসন বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে পরীক্ষার্থীরা অসুবিধায় না পড়েন। তবে সেতু বন্ধ ও যানজটের কারণে অনেক পরীক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছেন। বিকল্প পথ হিসেবে ধুলাগড়–নিবরা–সালোপ–পাকুরিয়া–সিসিআর ব্রিজ হয়ে নিবেদিতা সেতু ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।
আরজি কর কাণ্ডের এক বছর পূর্তিতে এই নবান্ন অভিযান শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, বরং ন্যায়বিচারের দাবিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের একতাবদ্ধতার প্রতীক। নির্যাতিতার পরিবারের অটুট সংকল্প ও হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে সমাজ এখনও ন্যায়বিচারের আশায় রয়েছে। পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে জনগণ ন্যায়বিচারের প্রশ্নে কোনো আপস করতে রাজি নয়।