Naka checking rules: নাকা চেকিং বা পুলিশ চেকিং-এর সময় গাড়ি বা বাইক থামানো হলে অনেকেই ঘাবড়ে যান। এই সময় পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়লে এবং আপনার কোনো জিনিস বা এমনকি গাড়িটি বাজেয়াপ্ত বা ‘সিজ’ (Seize) করা হলে, আপনার আইনি অধিকার কী? পুলিশ কি আপনাকে একটি ‘সিজার লিস্ট’ (Seizure List) বা জব্দ তালিকা দিতে আইনত বাধ্য? এক কথায় উত্তর হলো: হ্যাঁ। যদি পুলিশ আপনার কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তা গাড়ির নথি হোক বা স্বয়ং গাড়িটি, আইনত বাজেয়াপ্ত করে, তবে আপনাকে একটি বিস্তারিত সিজার লিস্ট বা মেমো দেওয়া তাদের আইনি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই অধিকারটি মূলত ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রক্রিয়ার (Code of Criminal Procedure, 1973) ধারা ১০২ (Section 102) এবং মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট, ১৯৮৮ (Motor Vehicles Act, 1988) দ্বারা সুরক্ষিত। এই বিষয়ে অজ্ঞতা আপনাকে ভবিষ্যতে বড় আইনি জটিলতায় ফেলতে পারে, আপনার বাজেয়াপ্ত হওয়া সম্পত্তি ফেরত পাওয়া কঠিন করে তুলতে পারে।

এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো নাকা চেকিং কী, সিজার লিস্টের আইনি গুরুত্ব, কখন পুলিশ এটি দিতে বাধ্য, এবং যদি আপনাকে এই লিস্ট না দেওয়া হয়, তবে আপনার কী করণীয়। সম্পূর্ণ বিষয়টি জানা থাকলে, আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারবেন এবং যেকোনো পুলিশি হয়রানি বা আইনি জটিলতা এড়াতে পারবেন।

নাকা চেকিং (Naka Checking) আসলে কী এবং কেন এটি করা হয়?

‘নাকা চেকিং’ বা ‘নাকা বন্দি’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ, যা পুলিশ বা অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত এক ধরনের নিরাপত্তা বা ট্র্যাফিক তল্লাশি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে অস্থায়ী ব্যারিকেড তৈরি করে করা হয়।

নাকা চেকিং-এর উদ্দেশ্য

নাকা চেকিং-এর উদ্দেশ্য বহুমুখী হতে পারে। এর আইনি ভিত্তি মূলত পুলিশ আইন, ১৮৬১ এবং কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (CrPC), ১৯৭৩-এর বিভিন্ন ধারার উপর নির্ভরশীল।

• অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ: সন্দেহভাজন ব্যক্তি, চোরাচালানকারী, বা অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের ধরার জন্য এই ধরনের চেকিং করা হয়। অস্ত্র, মাদক, বা চোরাই মালের পাচার রোধ করা এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

• আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা: বিশেষ কোনো ঘটনা, উৎসব বা উত্তেজনামূলক পরিস্থিতির আগে বা পরে শহরের নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নাকা চেকিং করা হয়।

• ট্র্যাফিক আইন বলবৎ: এটি নাকা চেকিং-এর সবচেয়ে সাধারণ রূপ। এই চেকিং-এর মাধ্যমে চালকের লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন (RC), পলিউশন সার্টিফিকেট (PUC), এবং ইন্স্যুরেন্স পরীক্ষা করা হয়। মোটর ভেহিকেলস (সংশোধনী) অ্যাক্ট, ২০১৯ অনুযায়ী, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো (Drunk Driving), হেলমেট বা সিট বেল্ট না পরা, বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মতো অপরাধ ধরা হয়।

• সন্ত্রাস দমন: সংবেদনশীল এলাকায় বা কোনো নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা বিস্ফোরক বহন রোধ করার জন্য উচ্চ-নিরাপত্তা নাকা চেকিং করা হয়।

নাকা চেকিং আইনত বৈধ, যতক্ষণ পর্যন্ত এটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং নাগরিকদের অধিকারকে সম্মান করে পরিচালিত হয়। পুলিশ কর্মীরা এই সময় আইন অনুযায়ী তল্লাশি চালাতে পারেন, কিন্তু তারা নাগরিকদের সাথে কোনো অশোভন আচরণ বা হয়রানি করতে পারেন না।

সিজার লিস্ট (Seizure List) কী? এটি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

‘সিজার লিস্ট’, যা আইনত ‘সিজার মেমো’ (Seizure Memo) বা ‘জব্দ তালিকা’ নামে পরিচিত, একটি আনুষ্ঠানিক আইনি নথি। যখন কোনো পুলিশ অফিসার বা তদন্তকারী সংস্থা কোনো তদন্তের স্বার্থে কোনো ব্যক্তি বা স্থান থেকে কোনো বস্তু বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত (seize) করেন, তখন এই নথিটি তৈরি করা বাধ্যতামূলক।

সিজার লিস্টের আইনি ভিত্তি

সিজার লিস্টের মূল আইনি ভিত্তি হলো কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (CrPC), ১৯৭৩।

১. ধারা ১০২ (Section 102): এই ধারা পুলিশকে কোনো এমন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয় যা কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হয় বা যা অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। CrPC-এর ধারা ১০২(৩) অনুযায়ী, বাজেয়াপ্ত করার পর পুলিশ অফিসারকে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি রিপোর্ট জমা দিতে হয়।

২. ধারা ১০০ (Section 100): এই ধারাটি তল্লাশি (Search) সংক্রান্ত পদ্ধতি নিয়ে কথা বলে। ধারা ১০০(৫) অনুযায়ী, তল্লাশির সময় বাজেয়াপ্ত করা সমস্ত জিনিসের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে এবং সেই তালিকায় অন্তত দুজন স্বাধীন ও সম্মানীয় স্থানীয় সাক্ষী (witness) স্বাক্ষর করবেন।

৩. ধারা ১০০(৬) ও (৭): এই ধারাগুলি আরও স্পষ্ট করে যে, ওই তালিকার একটি কপি (যাকে সিজার লিস্ট বলা হয়) সেই ব্যক্তিকে দিতে হবে যার কাছ থেকে বা যার স্থান থেকে ওই জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যদি সেই ব্যক্তি উপস্থিত না থাকেন, তবে তার পক্ষে উপস্থিত কোনো ব্যক্তিকে বা সাক্ষীদের একজনকে ওই কপির জন্য আবেদন করতে বলা যেতে পারে।

একটি বৈধ সিজার লিস্টে কী কী থাকা উচিত?

একটি সিজার লিস্ট শুধুমাত্র একটি কাগজের টুকরো নয়; এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রমাণ। এর গুরুত্ব অপরিসীম কারণ এটি বাজেয়াপ্ত করা জিনিসগুলির একটি আনুষ্ঠানিক রেকর্ড। এটি নিশ্চিত করে যে পুলিশ যা বাজেয়াপ্ত করেছে, তার বাইরে কিছু দাবি করতে পারবে না এবং বাজেয়াপ্ত করা জিনিসগুলি পরে পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপন করা হয়নি। আদালতে মামলা চলাকালীন এই লিস্টটি একটি প্রধান প্রমাণ হিসাবে কাজ করে।

একটি আদর্শ ও আইনত বৈধ সিজার লিস্টে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা বাধ্যতামূলক:

বিষয়বস্তু (Content)	বিবরণ
শিরোনাম	স্পষ্ট করে “সিজার লিস্ট” বা “জব্দ তালিকা” (Seizure Memo) লেখা।
কেস/জিডি নম্বর	যে মামলা বা জেনারেল ডায়েরির (GD) ভিত্তিতে এই বাজেয়াপ্তকরণ হচ্ছে, তার নম্বর।
তারিখ ও সময়	ঠিক কখন এবং কোন তারিখে জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করা হলো।
স্থান	যে নির্দিষ্ট স্থান থেকে (যেমন, নাকা চেকিং পয়েন্ট, বাড়ি) জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করা হলো।
অফিসারের বিবরণ	যে পুলিশ অফিসার (তদন্তকারী অফিসার) জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করছেন, তার নাম, পদ (Rank) এবং ব্যাজ নম্বর।
ব্যক্তির বিবরণ	যার কাছ থেকে জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, তার নাম, ঠিকানা ও পরিচয়।
বাজেয়াপ্ত সামগ্রীর তালিকা	এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত বিবরণ (যেমন, মোবাইল হলে তার মডেল, IMEI নম্বর; গাড়ি হলে তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর, চেসিস নম্বর; টাকা হলে তার পরিমাণ)।
সাক্ষীদের বিবরণ	অন্তত দুজন স্বাধীন সাক্ষীর নাম, ঠিকানা এবং স্বাক্ষর। আইন অনুযায়ী, পুলিশ নিজেরা সাক্ষী হতে পারে না।
অফিসারের স্বাক্ষর	বাজেয়াপ্তকারী অফিসারের স্বাক্ষর ও পুলিশ স্টেশনের সিল।
প্রাপ্তির কপি	যার জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হলো, তিনি যে সিজার লিস্টের একটি কপি পেয়েছেন, তার স্বাক্ষর (Acknowledgment)।

---

মূল প্রশ্ন: নাকা চেকিং-এর পর সিজার লিস্ট কি সবসময় বাধ্যতামূলক?

এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে দেওয়া সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে নাকা চেকিং-এর সময় কী ঘটেছে, তার উপর। আসুন পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি বিশ্লেষণ করি।

পরিস্থিতি ১: সাধারণ চেকিং (কোনও কিছুই বাজেয়াপ্ত হয়নি)

আপনি গাড়ি বা বাইক চালাচ্ছেন, পুলিশ আপনাকে নাকা চেকিং-এ থামালো। তারা আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (RC), ইন্স্যুরেন্স এবং পলিউশন সার্টিফিকেট (PUC) দেখতে চাইলো।

আইন: মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট, ১৯৮৮-এর ধারা ১৩০ অনুযায়ী, পুলিশ চাইলে আপনি এই নথিগুলি দেখাতে বাধ্য। তবে, মিনিস্ট্রি অফ রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়েজ (MORTH) -এর নির্দেশিকা এবং ২০১৯ সালের সংশোধনী অনুযায়ী, আপনি সরকারের অনুমোদিত অ্যাপ যেমন DigiLocker বা mParivahan অ্যাপে সংরক্ষিত ডিজিটাল কপিও দেখাতে পারেন। এগুলি ফিজিক্যাল কপির মতোই বৈধ।

সিদ্ধান্ত: পুলিশ আপনার নথিগুলি পরীক্ষা করলো, দেখলো সব ঠিক আছে, এবং আপনাকে চলে যেতে বললো। এই ক্ষেত্রে, আপনার কোনো জিনিস বাজেয়াপ্ত (seize) করা হয়নি। তাই, পুলিশ আপনাকে কোনো সিজার লিস্ট বা কোনো প্রকার মেমো দিতে বাধ্য নয়।

পরিস্থিতি ২: গাড়ির নথি (Documents) বাজেয়াপ্ত করা হলে

ধরুন, আপনার কাছে কোনো একটি বৈধ নথি (যেমন, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা RC) নেই, অথবা নথির সত্যতা নিয়ে পুলিশের সন্দেহ আছে।

আইন: মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট-এর ধারা ২০৬ অনুযায়ী, যদি পুলিশের সন্দেহ হয় যে আপনি কোনো অপরাধ করেছেন (যেমন, লাইসেন্স সাসপেন্ডেড থাকা সত্ত্বেও গাড়ি চালানো), তবে তারা আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স বা অন্যান্য নথি বাজেয়াপ্ত (impound) করতে পারে।

সিদ্ধান্ত: এই ক্ষেত্রে, পুলিশ আপনার নথি বাজেয়াপ্ত করলে, আপনাকে অবশ্যই একটি আনুষ্ঠানিক প্রাপ্তিস্বীকার পত্র (Acknowledgment Receipt) বা মেমো দিতে বাধ্য। এই রসিদটি প্রমাণ হিসাবে কাজ করবে যে আপনার নথি পুলিশের কাছে জমা আছে এবং আপনি এটি দেখিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গাড়ি চালাতে পারবেন (যদি আইন অনুমতি দেয়) বা পরে আসল নথি দেখিয়ে এটি ছাড়িয়ে আনতে পারবেন। এই রসিদটি সিজার লিস্টের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিস্থিতি ৩: গাড়ি বা বাইক বাজেয়াপ্ত (Seize) করা হলে

এটি একটি গুরুতর পরিস্থিতি। ধরুন, আপনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন, বা আপনার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস বা পারমিট নেই, অথবা গাড়িটি কোনো অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

আইন: মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট-এর ধারা ২০৭ পুলিশকে এই ধরনের গাড়ি আটক বা বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয়। এছাড়াও, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ধারা ১৮৫ -তে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যার মধ্যে গাড়ি বাজেয়াপ্ত করাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

সিদ্ধান্ত: এই ক্ষেত্রে, যখন আপনার গাড়ি বা বাইকটিই বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, তখন পুলিশ অফিসার CrPC-এর ধারা ১০২ এবং ১০০ মেনে একটি সম্পূর্ণ এবং বিস্তারিত সিজার লিস্ট (Seizure Memo) তৈরি করতে এবং তার একটি কপি আপনাকে প্রদান করতে আইনত ১০০% বাধ্য। এই লিস্টে আপনার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিনের নম্বর এবং গাড়িতে থাকা সমস্ত জিনিসের (যেমন, স্টেপনি, টুলকিট, বা আপনার ব্যক্তিগত কোনো মূল্যবান জিনিস) উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়।

পরিস্থিতি ৪: তল্লাশিতে সন্দেহজনক বস্তু পাওয়া গেলে

নাকা চেকিং-এর সময় পুলিশ যদি আপনার গাড়ি তল্লাশি করে (যথাযথ সন্দেহের ভিত্তিতে) এবং কোনো বেআইনি বা সন্দেহজনক বস্তু (যেমন, বেআইনি অস্ত্র, মাদক, বিপুল পরিমাণ অজ্ঞাত অর্থ, বা চোরাই মাল) খুঁজে পায়।

আইন: এই ধরনের বস্তু বাজেয়াপ্ত করা CrPC-এর ধারা ১০২ -এর আওতায় পড়ে। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ।

সিদ্ধান্ত: এই পরিস্থিতিতেও, সিজার লিস্ট তৈরি করা এবং তার একটি কপি আপনাকে বা আপনার প্রতিনিধিকে দেওয়া বাধ্যতামূলক। এটি না করা একটি গুরুতর পদ্ধতিগত ত্রুটি (Procedural Lapse) যা আদালতে পুলিশের কেসকে দুর্বল করে দিতে পারে।

আইন আপনার অধিকারে: নাকা চেকিং-এ নাগরিক হিসাবে আপনার কী কী অধিকার আছে?

আইন যেমন পুলিশকে ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনই নাগরিকদের অধিকারকেও সুরক্ষিত করেছে। নাকা চেকিং-এর সময় আপনার অধিকারগুলি জানা অত্যন্ত জরুরি।

• ভদ্র আচরণ পাওয়ার অধিকার: পুলিশ আপনার সাথে ভদ্রভাবে এবং সম্মানের সাথে কথা বলতে বাধ্য। তারা কোনোভাবেই আপনাকে গালিগালাজ বা অপমান করতে পারে না।

• পুলিশের পরিচয় জানার অধিকার: আপনি যদি সিভিল ড্রেসে থাকা কোনো পুলিশ কর্মীর দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হন, আপনি বিনয়ের সাথে তার পরিচয়পত্র (Identity Card) দেখতে চাইতে পারেন। ইউনিফর্মে থাকলে তার নেম প্লেট এবং ব্যাজ নম্বর দেখার অধিকার আপনার আছে।

• চেকিং-এর কারণ জানার অধিকার: আপনি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করতে পারেন আপনাকে কেন থামানো হয়েছে বা আপনার গাড়ি কেন তল্লাশি করা হচ্ছে।

• তল্লাশির সময় সুরক্ষা: যদি আপনার গাড়ি তল্লাশি করার প্রয়োজন হয়, তবে তা আইন মেনে করতে হবে। মহিলাদের তল্লাশির ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন মহিলা পুলিশ অফিসারের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

• জোর করে ফোন আনলক না করা: পুলিশ আপনাকে আপনার ফোন আনলক করতে বা পাসওয়ার্ড দিতে বাধ্য করতে পারে না, যদি না তাদের কাছে আদালতের নির্দিষ্ট ওয়ারেন্ট বা কোনো গুরুতর অপরাধের (যেমন, সন্ত্রাসবাদ) জোরালো প্রমাণ থাকে।

• সিজার লিস্ট পাওয়ার অধিকার: যেমনটি আগেই বিস্তারিত বলা হয়েছে, আপনার কোনো জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হলে, তার সিজার লিস্ট পাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আপনার আছে।

• আইনি সহায়তা নেওয়ার অধিকার: যদি আপনাকে আটক করা হয়, তবে আপনার অধিকার আছে আপনার আইনজীবী বা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার।

পুলিশ অফিসারের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা

এটাও মনে রাখা দরকার যে পুলিশ অফিসাররা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদেরও কিছু নির্দিষ্ট ক্ষমতা আইন দ্বারা প্রদত্ত।

ক্ষমতা (Powers):

১. ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গের জন্য বা সন্দেহের বশে যেকোনো গাড়ি থামানোর ক্ষমতা।

২. ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির নথি পরীক্ষা করার ক্ষমতা (MVA, ধারা ১৩০)।

৩. নথি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা (MVA, ধারা ২০৬)।

৪. নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গাড়ি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা (MVA, ধারা ২০৭)।

৫. মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালালে ব্রেথ অ্যানালাইজার টেস্ট করার ক্ষমতা।

সীমাবদ্ধতা (Limitations):

১. তারা আপনার থেকে গাড়ির চাবি কেড়ে নিতে পারে না (যদি না গাড়িটি বাজেয়াপ্ত করার নির্দিষ্ট কারণ থাকে)।

২. তারা আপনাকে শারীরিকভাবে হেনস্থা বা মারধর করতে পারে না।

৩. তারা আপনাকে অকারণে দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে পারে না।

৪. সিজার লিস্ট বা রসিদ না দিয়ে আপনার কোনো জিনিস তারা নিয়ে যেতে পারে না।

৫. অনেক ট্র্যাফিক অপরাধের জন্য (যেমন, হেলমেট না পরা) জরিমানা এখন ই-চালান (e-challan) -এর মাধ্যমে অনলাইনে মেটানোর নিয়ম। তারা বেআইনিভাবে আপনার থেকে নগদ টাকা দাবি করতে পারে না।

তথ্য ও পরিসংখ্যান: ট্র্যাফিক আইন এবং সচেতনতা

ভারতে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা এবং ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘনের সংখ্যা 엄청। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) -এর তথ্য (যেমন, “ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া” রিপোর্ট) এবং মিনিস্ট্রি অফ রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়েজ (MORTH)-এর বার্ষিক রিপোর্টগুলি দেখায় যে ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন একটি বড় সমস্যা।

উদাহরণস্বরূপ, MORTH-এর “Road Accidents in India – 2022” রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে ৪,৬১,৩১২ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ১,৬৮,৪৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনাগুলির একটি বড় অংশের পিছনে রয়েছে ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন, যেমন বেপরোয়া গতি, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, এবং সিগন্যাল না মানা।

এই বিপুল সংখ্যক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা মোকাবিলার জন্যই পুলিশকে নাকা চেকিং এবং ই-চালানের মতো পদক্ষেপ নিতে হয়। ২০১৯ সালের মোটর ভেহিকেলস (সংশোধনী) অ্যাক্ট চালু করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জরিমানা বাড়িয়ে এবং প্রযুক্তি (যেমন, ডিজিটাল নথি, ই-চালান) ব্যবহার করে এই লঙ্ঘনগুলি কমানো এবং সড়কে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা। এই পরিসংখ্যানগুলি এটা বুঝতে সাহায্য করে যে নাকা চেকিং শুধুমাত্র নাগরিকদের হয়রানি করার জন্য নয়, বরং এটি বৃহত্তর জননিরাপত্তার স্বার্থে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তবে, এই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় আইন মেনে চলা উভয় পক্ষের (নাগরিক ও পুলিশ) জন্যই বাধ্যতামূলক।

যদি আপনাকে সিজার লিস্ট না দেওয়া হয়, তাহলে আপনার করণীয় কী?

এটি একটি বাস্তবসম্মত সমস্যা। অনেক সময় পুলিশ কর্মীরা অজ্ঞতার কারণে বা তাড়াহুড়োয় সিজার লিস্ট দেন না, আবার কখনো কখনো অসাধু কর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে এটি এড়িয়ে যান। যদি আপনার সাথে এমন ঘটনা ঘটে, তবে আতঙ্কিত না হয়ে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করুন:

১. শান্ত থাকুন এবং বিনয়ের সাথে অনুরোধ করুন: প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে, শান্তভাবে এবং বিনয়ের সাথে অফিসারকে একটি সিজার লিস্ট বা অন্ততপক্ষে একটি লিখিত রসিদ (acknowledgment) দেওয়ার জন্য অনুরোধ করুন। বলুন যে এটি আপনার আইনি অধিকার এবং আপনার সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য এটি প্রয়োজন।

২. অফিসারের বিবরণ নোট করুন: যদি তারা দিতে অস্বীকার করে, তবে তর্কাতর্কিতে জড়াবেন না। শান্তভাবে সেখান থেকে সরে আসুন এবং অবিলম্বে ওই পুলিশ অফিসারের নাম (নেম প্লেট থেকে), ব্যাজ নম্বর, গাড়ির নম্বর (যদি থাকে), পুলিশ স্টেশনের নাম, এবং ঘটনার সঠিক সময় ও স্থান একটি ডায়েরিতে বা মোবাইলে নোট করে রাখুন।

৩. সাক্ষী জোগাড় করুন: যদি আশেপাশে কোনো লোক থাকে যারা ঘটনাটি দেখছে, তাদের নাম ও ফোন নম্বর জোগাড় করার চেষ্টা করুন। তারা পরবর্তীকালে সাক্ষী হিসাবে কাজে লাগতে পারে।

৪. উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ: যত দ্রুত সম্ভব, ওই পুলিশ অফিসারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের (যেমন, নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনের ইন্সপেক্টর-ইন-চার্জ, বা জেলার পুলিশ সুপার (SP) বা পুলিশ কমিশনারের) কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করুন। আপনার অভিযোগে ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ, অভিযুক্ত অফিসারের বিবরণ, এবং সিজার লিস্ট না দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন। অভিযোগের একটি রিসিভড কপি (received copy) অবশ্যই নিজের কাছে রাখুন। অনেক রাজ্য পুলিশের এখন অনলাইন অভিযোগ পোর্টালও (Online Grievance Portal) রয়েছে।

৫. আদালতের দ্বারস্থ হোন: যদি আপনার বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি (যেমন, গাড়ি বা বাইক) মূল্যবান হয় এবং পুলিশি অভিযোগের পরেও আপনি কোনো সুরাহা না পান, তবে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া।

৬. আইনি পরামর্শ নিন: একজন ভালো আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। তিনি আপনাকে আপনার বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য (Releasing the vehicle) আদালতে আবেদন (CrPC-এর ধারা ৪৫১ বা ৪৫৭-এর অধীনে) করতে সাহায্য করতে পারেন। আদালতে আপনার এই অভিযোগ যে আপনাকে সিজার লিস্ট দেওয়া হয়নি, তা পুলিশের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পয়েন্ট হিসাবে কাজ করবে। আইনি তথ্যের জন্য আপনি LiveLaw বা Bar & Bench -এর মতো নির্ভরযোগ্য আইনি সংবাদ মাধ্যমগুলিও দেখতে পারেন।

পরিশেষে, “নাকা চেকিং এর পর সিজার লিস্ট দেওয়া কি বাধ্যতামূলক?” – এই প্রশ্নের উত্তর হলো: যদি আপনার কোনো জিনিস আইনত বাজেয়াপ্ত বা ‘সিজ’ করা হয়, তবে সিজার লিস্ট বা রসিদ দেওয়া একেবারে বাধ্যতামূলক।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং বিভিন্ন হাইকোর্ট একাধিকবার তাদের রায়ে বলেছেন যে, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি (procedure established by law) মেনে চলাই হলো আইনের শাসনের ভিত্তি। সিজার লিস্ট তৈরি করা সেই পদ্ধতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে।

একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে, আপনার দায়িত্ব হলো আইন মেনে চলা (যেমন, সমস্ত বৈধ নথি সাথে রাখা বা ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা) এবং একই সাথে নিজের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। নাকা চেকিং-এ পুলিশকে সহযোগিতা করুন, কিন্তু আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে বিনয়ের সাথে অথচ দৃঢ়ভাবে তা রক্ষা করুন। আইন জানা থাকলে, আপনি অহেতুক হয়রানি বা আইনি জটিলতা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।