Digital crime tracking India: ভারতের পুলিশি ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অভিনব উদ্যোগ হল ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিস্টেমস (CCTNS)। এটি একটি সর্বভারতীয় অনলাইন ট্র্যাকিং সিস্টেম যা দেশের ১৭,১৭১ পুলিশ স্টেশনকে একটি ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত করে, যা অপরাধ তদন্ত এবং অপরাধীদের সনাক্তকরণে নতুন মাত্রা এনেছে। ২০০৯ সালে ২,০০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করে এই প্রকল্প শুরু হয়, যার মূল উদ্দেশ্য হল পুলিশ স্টেশন পর্যায়ে কার্যক্রমের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধান প্রদান কর।
CCTNS: পটভূমি ও উদ্দেশ্য
২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর, তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরম পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বর্ধিত সমন্বয় ও তথ্য আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে CCTNS-এর ধারণা প্রস্তাব করেন। ২০০৯ সালে মন্ত্রিসভার অর্থনৈতিক বিষয়ক কমিটি (CCEA) প্রকল্পটি অনুমোদন করে এবং এটি ন্যাশনাল ই-গভর্নেন্স প্ল্যানের অধীনে মিশন মোড প্রজেক্ট (MMP) হিসাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
মাস্টারস্ট্রোক ভারতের! চালু হল “ভারতপোল”, অপরাধীদের আর নেই নিস্তার
CCTNS-এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল:
-
পুলিশ স্টেশন পর্যায়ে কার্যক্রমের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা
-
অপরাধ তদন্ত, অপরাধ প্রতিরোধ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উন্নত সরঞ্জাম প্রদান করা
-
ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া হ্রাস করে পরিচালনাগত দক্ষতা বাড়ানো
-
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কিত তথ্য ভাগ করার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা
-
জনসাধারণের জন্য সেবা প্রদানের মান উন্নত করা
CCTNS-এর কার্যপ্রণালী ও বাস্তবায়ন
CCTNS প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে কোর অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার (CAS) এর মাধ্যমে, যা বাঙ্গালোর ভিত্তিক আইটি সংস্থা উইপ্রো দ্বারা বিকশিত হয়েছে। এই সফটওয়্যারটি ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিস্তৃত, বিভিন্ন রাজ্যের প্রচলিত সফটওয়্যার ও প্ল্যাটফর্মগুলিকে একীভূত করে এবং যেসব রাজ্য এখনও তাদের পুলিশি রেকর্ড ডিজিটাইজ করেনি, সেগুলিও ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করে।
CCTNS বাস্তবায়নের প্রধান উপাদানগুলি হল:
-
প্রায় ১৫,০০০ পুলিশ স্টেশন এবং অতিরিক্ত ৫,০০০ উচ্চ পুলিশ অফিসকে একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করা
-
এফআইআর নিবন্ধন, তদন্ত এবং চার্জশিট সম্পর্কিত তথ্য ডিজিটাইজ করা
-
অপরাধ ও অপরাধীদের একটি জাতীয় ডাটাবেস বিকাশ করা
-
নাগরিক পোর্টাল স্থাপন করা যা রাজ্য-স্তরের নাগরিক পোর্টালের সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং নাগরিক-বান্ধব সেবা প্রদান করবে
-
পুলিশ কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ই-গভর্নেন্স শক্তিশালী করা
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ভারতের সমস্ত ১৭,১৭১ পুলিশ স্টেশন CCTNS-এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে এবং এটি ব্যবহার করছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ২,০০০ কোটি টাকা, যা মার্চ ২০২২ পর্যন্ত অতিরিক্ত পাঁচ বছরের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যায়ও অন্তর্ভুক্ত করে।
এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক যাতে অপরাধ করার আগেই ভয়ের সঞ্চার হয়’- অভিনেতা অর্ণব ভদ্র!
CCTNS-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা
সর্বভারতীয় একীকরণ ও ডাটাবেস
CCTNS সিস্টেম দেশজুড়ে সমস্ত পুলিশ স্টেশন থেকে অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে সংরক্ষণ করে। এই ব্যাপক ডাটাবেসে অভিযুক্ত ব্যক্তি, অভ্যস্ত অপরাধী, ঘোষিত অপরাধী এবং অপরাধ-সম্পর্কিত তথ্য যেমন নিখোঁজ ব্যক্তি এবং চুরি যাওয়া গাড়ির তথ্য সংরক্ষিত থাকে। সিস্টেমটি পুলিশ স্টেশন পর্যায়ে বিশ্লেষণাত্মক টুল প্রদান করে, যা অপরাধ পরিসংখ্যান এবং বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করতে সাহায্য করে।
নাগরিক সেবা ও সুবিধা
CCTNS-এর মাধ্যমে নাগরিকরা অভিযোগ ট্র্যাকিং, যাচাইকরণ অনুরোধ এবং কেস আপডেট জানতে পারেন, যা পুলিশি প্রক্রিয়াকে আরও সহজলভ্য করে তোলে। ডিজিটাল পুলিশ পোর্টাল এবং কেন্দ্রীয় নাগরিক সেবা পোর্টালের মাধ্যমে জাতীয় স্তরে নাগরিকদের বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়। এছাড়া, রাজ্য CCTNS নাগরিক পোর্টালগুলি ৯টি বাধ্যতামূলক নাগরিক সেবা প্রদান করে, যেমন অনলাইন অভিযোগ, চরিত্র সার্টিফিকেট, ব্যক্তি যাচাইকরণ এবং ভাড়াটে যাচাইকরণ।
ইন্টারঅপারেবল ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম (ICJS)
CCTNS এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ইন্টারঅপারেবল ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম (ICJS), যা CCTNS-কে ই-কোর্টস, ই-প্রিজনস, ফরেনসিকস এবং প্রসিকিউশন সিস্টেমের সাথে একীভূত করে13। ICJS বাস্তবায়নের ফলে:
-
অপরাধ ন্যায় ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তম্ভের মধ্যে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব হয়, যা স্বচ্ছতা বাড়ায় এবং প্রক্রিয়াকরণের সময় কমায়
-
জাতীয় স্তরে অপরাধ বিশ্লেষণ প্রকাশ করা সম্ভব হয়, যা নীতি নির্ধারক এবং আইন প্রণেতাদের উপযুক্ত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে
-
আন্তঃরাজ্য অপরাধী গতিবিধি ট্র্যাকিং উন্নত করার জন্য আঞ্চলিক ভাষায় সারা ভারত জুড়ে অপরাধী/অভিযুক্তের নাম অনুসন্ধান সক্ষম করে
CCTNS-এর অন্যান্য অংশ ও অ্যাপ্লিকেশন
CCTNS প্রকল্পের অধীনে বেশ কিছু বিশেষায়িত সিস্টেম ও অ্যাপ্লিকেশন বিকশিত হয়েছে:
-
CCTNS CAS অ্যাপ্লিকেশন: অভিযোগ/এফআইআর দাখিল, অপরাধ রিপোর্ট, গ্রেপ্তারি, সমর্পণ এবং চার্জশিট ইত্যাদির জন্য
-
ঝাড়খণ্ড COP (মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন): এফআইআর অনুসন্ধান, অপরাধ রিপোর্ট, মুলতবি মামলা, আইও পারফরম্যান্স ইত্যাদি ট্র্যাক করার জন্য
-
সাইবার পুলিশ পোর্টাল: সাইবার অভিযোগের জন্য
-
ন্যাশনাল ডাটাবেস ফর সেক্সুয়াল অফেন্ডার্স (NDSO): যৌন অপরাধীদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য
-
ইনভেস্টিগেশন ট্র্যাকিং সিস্টেম ফর সেক্সুয়াল অফেন্সেস (ITSSO): যৌন অপরাধ মামলার রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিংয়ের জন্য
-
ক্রাইম মাল্টি এজেন্সি সেন্টার (CRI-MAC): জঘন্য অপরাধ এবং আন্তঃরাজ্য সমন্বয় সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করার জন্য
CCTNS বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
CCTNS বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, যেমন বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন সফটওয়্যার ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার, পুরানো রেকর্ড ডিজিটাইজেশন এবং পুলিশ কর্মীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেওয়া পদক্ষেপগুলি হল:
-
সব রাজ্যে একটি সাধারণ সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম (CAS) বাস্তবায়ন
-
পুলিশ কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ
-
রাজ্য ডাটা কেন্দ্র, নিয়ার ডাটা কেন্দ্র এবং দুর্যোগ পুনরুদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন
-
বিভিন্ন রাজ্যের পুরানো ডাটা ডিজিটাইজেশনের জন্য বিশেষ প্রকল্প
CCTNS-এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
নতুন অপরাধ আইনের অধীনে CCTNS একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে আধুনিক অপরাধ ধরন মোকাবেলা করা, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ সনাক্তকরণে সহায়তা করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে CCTNS-এর ক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যা অপরাধ বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহায্য করবে।
ভারতের সব পুলিশ স্টেশনে CCTNS সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হওয়ার পর, এটি দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন যুগের সূচনা করবে, যেখানে অপরাধ তদন্ত, আইন প্রয়োগ এবং নাগরিক সেবা আরও দক্ষ, স্বচ্ছ এবং কার্যকর হবে।
ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিস্টেমস (CCTNS) ভারতের পুলিশ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে একটি মাইলফলক। এই ব্যাপক এবং একীকৃত সিস্টেম পুলিশ স্টেশন পর্যায়ে কার্যকারিতা বাড়াতে, অপরাধ তদন্তে গতি আনতে এবং নাগরিকদের জন্য উন্নত পুলিশ সেবা নিশ্চিত করতে ই-গভর্নেন্সের নীতি প্রয়োগ করেছে। দেশের সমস্ত ১৭,১৭১টি পুলিশ স্টেশন এখন CCTNS-এর মাধ্যমে সংযুক্ত, যা ডিজিটাল ভারতের লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ।
CCTNS শুধু অপরাধ রেকর্ড ডিজিটাইজ করেই থামেনি, বরং এটি একটি সমন্বিত ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম তৈরি করেছে যা পুলিশ, আদালত, কারাগার, প্রসিকিউশন এবং ফরেনসিক সিস্টেমকে একীভূত করে। এই সিস্টেম অপরাধীদের সাধারণ ভাষায় “অপরাধ করুন এবং দৌড়ে পালান” মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে, কারণ এখন দেশের যে কোনো প্রান্তে অপরাধ করলেও অপরাধীকে খুঁজে বের করা অনেক সহজ হয়েছে।
আগামী দিনে, CCTNS আরও উন্নত হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি যেমন AI, ডাটা এনালিটিক্স এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে অপরাধ প্রতিরোধ এবং তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ করবে। CCTNS প্রকল্প প্রমাণ করে যে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন শুধু প্রাইভেট সেক্টরের বিষয় নয়, বরং সরকারি সেবা, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিতেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।