Neel Sashti vrat significance: চৈত্র মাসের শেষ দিকে বাঙালি হিন্দু পরিবারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পূজা হল নীলষষ্ঠী। সন্তানের মঙ্গলকামনায় বিবাহিত মহিলারা এই ব্রত পালন করে থাকেন। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২৫ সালে নীলষষ্ঠী পালিত হবে ১৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার। এদিন ভক্তরা সারাদিন উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলায় ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর পূজা করেন। বাঙালি সংস্কৃতিতে এই ব্রতের অনন্য গুরুত্ব রয়েছে যা বংশধরদের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনার সঙ্গে জড়িত।
নীলষষ্ঠী: ইতিহাস ও ঐতিহ্য
নীলষষ্ঠী বা নীল পূজা হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ লৌকিক উৎসব যা মূলত পূর্ব ভারতের বাংলা এবং বাংলাদেশে বিশেষ উৎসাহের সাথে পালিত হয়। এই উৎসব চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত হয়, যা সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে পড়ে। বাংলা বছরের শেষ ষষ্ঠী হিসেবে এই তিথিতে সনাতন বাঙালিরা নীলের ব্রত পালন করেন।
নীলষষ্ঠী নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। বহুল প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে, নীল শব্দটি “নীলকণ্ঠ” থেকে এসেছে, যা ভগবান শিবের একটি নাম। শিবের গলা নীল রঙের ছিল বলে তাঁকে নীলকণ্ঠ বলা হয়। আবার অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই দিন নীলচন্দিকা বা নীলাবতীর সাথে শিবের বিবাহ হয়েছিল বলে এই উৎসবের নাম নীলষষ্ঠী।
ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর দিব্য মিলন
নীলষষ্ঠী প্রধানত ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর বিবাহকে স্মরণ করে পালিত হয়। এই উৎসব পুরুষ ও নারী শক্তির দৈবিক মিলনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। হিন্দু ইতিহাস অনুসারে, ভগবান শিব বিশ্বের ধ্বংসকর্তা, অন্যদিকে দেবী পার্বতী সেই শক্তি যা বিশ্বকে ধারণ ও পোষণ করে। এদের মিলন বিশ্বে পুরুষ ও নারী শক্তির ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাংলায় এই উৎসবটি “নীলের পুজো” বা “নীলষষ্ঠী” নামেও পরিচিত। এটি মূলত বিবাহিত মহিলারা পালন করেন সন্তানদের মঙ্গলের জন্য। এই দিনে মায়েরা দেবী ষষ্ঠীর পূজা করেন এবং ভগবান শিবের জন্য বিশেষ প্রার্থনা নিবেদন করেন।
নীলষষ্ঠী ২০২৫: দিনক্ষণ ও শুভ সময়
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, ২০২৫ সালে নীলষষ্ঠী পালিত হবে ১৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার। এটি চৈত্র মাসের শেষ দিকে, চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয়। নীলষষ্ঠীর পরের দিনই চৈত্র মাসের শেষ দিন হিসেবে পালিত হয় যাকে চৈত্র সংক্রান্তি বলা হয়।
সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় নীলষষ্ঠীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন সারাদিন উপবাস রাখা হয় এবং সন্ধ্যায় শিবের মন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে পূজা করা হয়।
পূজার শুভ সময়: সন্ধ্যালগ্নে পূজা নিবেদন করার রীতি রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সূর্যাস্তের পর প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজার আয়োজন করা হয়।
নীলষষ্ঠীর রীতিনীতি ও পালন পদ্ধতি
নীলষষ্ঠী উপলক্ষে বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করা হয়। এই ব্রত মূলত বিবাহিত মহিলা ও অবিবাহিত কন্যারা পালন করেন। ব্রত পালনের পদ্ধতি এবং অনুষ্ঠানিকতা অঞ্চল ও পরিবার অনুসারে কিছুটা ভিন্ন হলেও, মূল বিষয়গুলি একই থাকে।
উপবাসের নিয়ম
নীলষষ্ঠীতে ব্রতধারীরা চৈত্রের প্রচণ্ড গরমে সারাদিন নির্জলা উপবাস পালন করেন। অনেকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু খান না, কেউ কেউ জল পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। এই উপবাস মন, শরীর ও আত্মার শুদ্ধিকরণে সাহায্য করে বলে বিশ্বাস করা হয়। উপবাসের মাধ্যমে ভক্তরা তাদের চিন্তাকে আধ্যাত্মিকতার দিকে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন।
পূজা বিধি
সন্ধ্যাবেলায় নীলষষ্ঠীর ব্রত সমাপন করা হয়। ব্রতধারীরা নিকটবর্তী শিব মন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গে দুধ ঢালেন এবং বেলপাতা ও ফুল নিবেদন করেন। ধূপ ও প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং ফল ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।
পূজা সমাপনের পর মায়েরা ঘরে ফিরে এসে “প্রসাদ” (ভগবানকে নিবেদিত ও পরে আশীর্বাদপ্রাপ্ত ফল) গ্রহণ করে উপবাস ভঙ্গ করেন। উপবাস ভঙ্গের পর সাবু ও দুধ-ময়দার খাবার খাওয়ার প্রথা রয়েছে।
নীলষষ্ঠীর দিন অনেক মা নীলকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় নৃত্য ও লোকগান গেয়ে থাকেন। নীলের এই গান গাওয়াকে অষ্টক বলা হয়।
সন্তানদের মঙ্গলের জন্য গুরুত্ব
নীলষষ্ঠী ব্রত মূলত সন্তানদের মঙ্গলের জন্য পালিত হয়। বিবাহিত মহিলারা কন্যা ও পুত্রসন্তানের নীরোগ ও সুস্থ জীবন কামনায় এই ব্রত পালন করে থাকেন। এই দিনে দেবী ষষ্ঠীরও পূজো করা হয়, যিনি মহিলাদের, বিশেষ করে তাঁদের বর্তমান ও অনাগত সন্তানদের মঙ্গলের প্রতীক।
উল্লেখ্য যে, নীলষষ্ঠী ব্রত উর্বরতার সাথেও সম্পর্কিত। বিবাহিত মহিলারা এবং যাঁরা মা হতে চান, তাঁরা সন্তান লাভের আশায় এই উপবাস পালন করেন। এছাড়া, এই পূজা সম্পূর্ণ ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে করলে পরিবারের সমৃদ্ধি ও মঙ্গল বাড়ে বলে বিশ্বাস করা হয়।
নীলষষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী
নীলষষ্ঠীর পিছনে একটি সুন্দর পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। এক সময় এক ব্রাহ্মণ দম্পতি গ্রামে বাস করতেন। তাঁরা ধার্মিক ছিলেন কিন্তু নীল পূজো সম্পর্কে জানতেন না। তাঁদের বেশ কয়েকটি সন্তান জন্মেছিল, কিন্তু কেউই বেশিদিন বাঁচেনি। বারবার সন্তান হারানোর শোকে দম্পতি ভেঙে পড়েন এবং জীবনের সব আনন্দ অর্থহীন মনে করেন।
দুঃখে তাঁরা কাশী চলে যান এবং একদিন গঙ্গাস্নান করে তীরে বসে কাঁদছিলেন। সেই সময় একজন বৃদ্ধা মহিলা তাঁদের কাছে এসে কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। স্ত্রী অশ্রুসিক্ত চোখে বৃদ্ধাকে তাঁদের সন্তানদের মৃত্যুর কথা বললেন। এই বৃদ্ধা মহিলা ছদ্মবেশে দেবী ষষ্ঠী ছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তাঁরা নীলষষ্ঠী পূজা পালন করেন কি না। বিস্মিত স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন এটা কী।
বৃদ্ধা তখন ব্যাখ্যা করলেন যে, চৈত্র মাস জুড়ে তপস্যা করতে হবে, এবং সংক্রান্তির আগের দিন দেবী ষষ্ঠী ও ভগবান শিবের পূজা করতে হবে। উপবাস শেষে নিরামিষ খাবার ও মিষ্টি করা লেবুর জল দিয়ে পারণ করতে হবে। এতে ভগবান শিব সন্তুষ্ট হয়ে সন্তানদের আশীর্বাদ করেন।
এই কথা বলে দেবী ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দম্পতি তারপর নিজেরাই এই ব্রত পালন করলেন এবং প্রতিবেশীদের মধ্যেও এই কাহিনী ছড়িয়ে দিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের আবার সন্তান লাভ হয়েছিল।
বাংলা সংস্কৃতিতে নীলষষ্ঠীর গুরুত্ব
বাংলা সংস্কৃতিতে নীলষষ্ঠীর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এটি বাংলা বছরের শেষ ষষ্ঠী হিসেবে পালিত হয়। নীলষষ্ঠীর পরের দিন চৈত্র সংক্রান্তি, যা বাংলা বছরের শেষ দিন, পালিত হয়। তারপরের দিন বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে নতুন বছর শুরু হয় যা পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়।
গ্রামবাংলায়, নীলষষ্ঠীর সময় বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়। গ্রামের লোকেরা “নীল পাগল” বা “জল কাথা” বলা কসমেটিক শিব নিয়ে অন্য গ্রামে যান এবং পূজার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমা করেন। এসব জিনিসের মধ্যে আছে ধান, তেল, চিনি, লবণ, মধু, টাকা ইত্যাদি।
এছাড়াও, নীল ও নীলাবতী নামে এক বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নীলের কোনো অবয়ব নেই, তবে নিম ও বেল কাঠকে নীলের মূর্তি হিসেবে পূজো করা হয়। নীলপূজোর আগের দিন অধিবাস পালন করা হয়, যখন গভীর রাতে দেবদেবীদের সংকল্প করে উপবাস রাখা হয়।
নীলষষ্ঠী পালনের উপকারিতা
নীলষষ্ঠী ব্রত পালনের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ও মানসিক উপকারিতা রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ:
- আধ্যাত্মিক শুদ্ধি: নীলষষ্ঠীতে উপবাস মন, দেহ ও আত্মাকে শুদ্ধ করে। এটি ভক্তদের আধ্যাত্মিকতার প্রতি মনোযোগী হতে সাহায্য করে এবং দিব্য শক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে।
- বৈবাহিক বন্ধন দৃঢ় করা: সাধারণত বিবাহিত ব্যক্তিরা নীলষষ্ঠী পূজা পালন করেন ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর আশীর্বাদ লাভের জন্য যাতে দাম্পত্য জীবনে সুখ ও স্থায়িত্ব আসে। তাঁরা বিশ্বাস করেন এই উপবাস স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য, ভালোবাসা ও বোঝাপড়া আনবে।
- সন্তানের মঙ্গল: নীলষষ্ঠী ব্রত উর্বরতার সাথেও সম্পর্কিত। বিবাহিত মহিলারা ও যাঁরা মা হতে চান, তাঁরা সন্তান লাভের আশায় এই উপবাস পালন করেন। এছাড়া, পূজা সম্পূর্ণ ভক্তি সহকারে করলে পরিবারের সমৃদ্ধি ও মঙ্গল বাড়ে বলে বিশ্বাস করা হয়।
- মনোবাঞ্ছা পূরণ: নীলষষ্ঠী পূজা মনের ইচ্ছা পূরণের জন্যও শুভ মনে করা হয়। ভক্তরা ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেন তাঁদের ইচ্ছা পূরণের জন্য এবং জীবনের বাধা দূর করার জন্য।
নীলষষ্ঠী বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা শিব ও পার্বতীর মিলনকে স্মরণ করে, সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে এবং পারিবারিক সুখ-শান্তি প্রার্থনা করে। ২০২৫ সালে ১৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার নীলষষ্ঠী পালিত হবে। ব্রতধারীরা সেদিন উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলায় শিব-পার্বতীর পূজা করবেন। এই ধরনের প্রাচীন রীতিনীতি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের জীবনে পারিবারিক মূল্যবোধ, ভালোবাসা ও শান্তির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক সময়ে, এই ধরনের ব্রত-উপবাস আমাদের ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ রক্ষা করে এবং নতুন প্রজন্মকে আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষিত করে।