ভারতের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আবারও এক কালো মেঘ নেমে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত NEET (National Eligibility cum Entrance Test) পরীক্ষার কেলেঙ্কারি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা শুধু পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতারও এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রাথমিক তদন্তে যা উঠে এসেছে, তা হলো একটি সুসংগঠিত চক্রের অস্তিত্ব, যারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের NEET-এ উচ্চ স্কোর করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই চক্রের সদস্যরা শুধু স্থানীয় দালাল নয়, তাদের মধ্যে রয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, এমনকি কিছু চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদও। তারা পরীক্ষা কেন্দ্রের কর্মীদের ঘুষ দিয়ে বশে এনে পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করেছিল। কেউ কেউ তো এমন দাবিও করেছেন যে, কিছু ক্ষেত্রে মूল প্রশ্নপত্রই ফাঁস করে দেওয়া হয়েছিল।
এই ধরনের কেলেঙ্কারি নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিবারই যেন তার মাত্রা ও ব্যাপ্তি বেড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এমনটা ঘটছে? কারা এর পেছনে? আর এর প্রভাব কতদূর?
প্রথমত, NEET পরীক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা অपরিসীম। ভারতের মতো একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশে, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, সেখানে এর ফলাফলের ওপর নির্ভর করে অনেকের ভবিষ্যৎ। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা এইসব তরুণ-তরুণীর আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের পরিবারের প্রত্যাশা অনেক সময় সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে, যে কোনো উপায়ে সফল হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশ বাণিজ্যিকীকরণের শিকার হচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে, অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এই সুযোগে মুনাফা লুটতে এগিয়ে আসছে। তারা জানে, অনেকেই যে কোনো মূল্যে সफলতা কিনতে প্রস্তুত। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা অসাধু পন্থা অবলম্বন করছে।
তৃতীয়ত, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুর্নীতি। যাদের দায়িত্ব ছিল এই ধরনের অপকর্ম রোধ করা, তাদের একাংশই যখন এতে জড়িত, তখন তদন্ত ও শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
এছাড়াও রয়েছে সামাজিক চাপ ও প্রতিযোগিতার বিষয়টি। ভারতীয় সমাজে চিকিৎসক হওয়া এখনও একটি উচ্চ মর্যাদার পেশা। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের এই পথে ঠেলে দেন, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই। ফলে, মেধা নয়, অর্থই হয়ে ওঠে প্রধান চালিকাশক্তি।
তবে এই ঘটনার প্রভাব শুধু বর্তমান পরীক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও ভয়াবহ। প্রথমত, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি ভুল বার্তা পাঠায় যে, সফলতার জন্য সততা জরুরি নয়। দ্বিতীয়ত, যারা অসৎ উপায়ে ডাক্তার হবে, তাদের নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। তৃতীয়ত, প্রকৃত মেধাবীরা হতাশ হয়ে পড়বে, অনেকে হয়তো বিদেশ পাড়ি জমাবে। সর্বোপরি, জনগণের মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে যাবে।
তাহলে এর প্রতিকার কী? প্রথমেই প্রয়োজন কঠোর আইনি ব্যবস্থা। যারাই এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। পাশাপাশি, পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আরও কঠোর ও স্বচ্ছ করতে হবে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এমন একটি পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কারसাজির সুযোগ কমে যায়।
কিন্তু শুধু আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, শিক্ষার লক্ষ্য শুধু ডিগ্রি অর্জন নয়, জ্ঞান ও মূল্যবোধ অর্জনও। পাশাপাশি, পরীক্ষার চাপ কমাতে শিক্ষাক্রমে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু একটি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর না করে, সামগ্রিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
সরকারের উচিত চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো। যত বেশি আসন ও প্রতিষ্ঠান থাকবে, প্রতিযোগিতার চাপ ততই কমবে। তবে এক্ষেত্রে মানের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কঠোর মানদণ্ডের মুখোমুখি করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, NEET স্ক্যাম ২০২৪ আমাদের সামনে হাজির করেছে এক দর্পণ। যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সমাজ ও ব্যবস্থার নগ্ন চেহারা। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। তা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে সমগ্র জাতিই পঙ্গু হয়ে পড়বে। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। সরকার, বিরোধী দল, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, গণমাধ্যম – সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য।
আমরা আশা করব, এই ঘটনা যেন শেষ হয়ে না ওঠে শুধু আরেকটি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে। বরং এটি যেন হয়ে ওঠে একটি মোড়, যেখান থেকে আমরা শুরু করব নতুন যাত্রা – একটি স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে। কারণ আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজ আমরা কী পদক্ষেপ নিচ
মন্তব্য করুন