Nepal Flood Latest Updates: উদ্ধারকাজ চলছেনেপালে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯২ জনে। এখনও ৩০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। দেশটির পুলিশ সূত্রে এই তথ্য জানানো হয়েছে। গত শুক্রবার থেকে অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে হিমালয়ের এই দেশটিতে বন্যা ও ভূমিধসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে আরও ৯৪ জন আহত হয়েছেন। উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঋষিরাম তিওয়ারি জানিয়েছেন।দেশজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্ধার ও ত্রাণকাজে নিয়োজিত করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত ৪,৫০০ জনেরও বেশি দুর্গত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য ও জরুরি ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে।দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর সাথে সংযোগকারী সব পথ এখনও অবরুদ্ধ রয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার যাত্রী আটকে পড়েছেন। অবরুদ্ধ মহাসড়কগুলো খোলার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।কাঠমান্ডুর প্রধান নদী বাগমতী বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার ও শনিবার নেপালের পূর্ব ও মধ্য অংশে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে এমনটি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক একীকৃত পর্বত উন্নয়ন কেন্দ্রের (ICIMOD) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি এবং মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তরে অবস্থানের কারণে শনিবার অস্বাভাবিক প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
Bangladesh Flood: বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ, ৩৬ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন, মৃত্যু বাড়ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এশিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে বন্যার প্রভাব বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হল অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকায়। এর ফলে পানি ধারণ ও নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকছে না।বন্যা ও ভূমিধসের কারণে দেশের বিভিন্ন অংশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক মহাসড়ক ও সড়কাংশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, শত শত বাড়ি ও সেতু ধ্বংস বা ভেসে গেছে এবং শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সড়ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হাজার হাজার যাত্রী বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়েছেন।কাঠমান্ডু সংলগ্ন ধাদিং জেলায় শনিবার একটি বাস ভূমিধসে চাপা পড়ে কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। ভক্তপুর শহরে একটি বাড়ি ভূমিধসে ধ্বসে পড়ে ৫ জন মারা গেছেন।মকওয়ানপুরে অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভূমিধসে ৬ জন ফুটবলার নিহত হয়েছেন। অন্যরা বন্যার পানিতে ভেসে গেছেন।
নেপাল পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, বন্যা ও ভূমিধসে কমপক্ষে ৩২২টি বাড়ি এবং ১৬টি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত ৪০-৪৫ বছরে কাঠমান্ডু উপত্যকায় এত ভয়াবহ বন্যা ও জলাবদ্ধতা তারা দেখেননি। আন্তর্জাতিক একীকৃত পর্বত উন্নয়ন কেন্দ্রের (ICIMOD) জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অরুণ ভক্ত শ্রেষ্ঠ বলেছেন, “আমি আগে কখনও কাঠমান্ডুতে এই পরিমাণে বন্যা দেখিনি।”
নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, যারা বাড়িঘর হারিয়েছেন তাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগ দিয়ে দেশে ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী খড়্গ প্রসাদ ওলি পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন।আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী মঙ্গলবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। তবে রবিবার থেকে কিছুটা স্বস্তির লক্ষণ দেখা গেছে।উত্তর বাংলাদেশেও তিস্তা নদী বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ৫টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ধান, সবজি ও মৎস্য চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে অনেক কৃষক আর্থিক সংকটে পড়েছেন।কাঠমান্ডু উপত্যকা বাগমতী নদী ও এর শাখা-প্রশাখায় ঘেরা। এসব নদীর পানি তীর ছাপিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীতীরে কাঠ ও টিনের তৈরি দুর্বল ঘরবাড়িগুলো ভেঙে পড়েছে। এসব ঘরে বসবাসকারী অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন।৬৫ বছর বয়সী এক বাসিন্দা বলেছেন, “এটা দুঃস্বপ্নের মতো। আমার জীবনে এত চরম বন্যা আগে কখনও দেখিনি। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।”
ভারত সরকার নেপালের সঙ্গে আলোচনা করছে বলে জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। তিনি বলেছেন, ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে বিহারের বন্যা সমস্যা সমাধানে ১১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।রাই আরও জানান, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন নেপালি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিহারের বন্যা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে একটি বিশেষজ্ঞ দল নেপাল সফর করে সপ্তকোশী হাই ড্যাম, সুনকোশী ডাইভারশন ব্যারাজ এবং কমলা নদীর বন্যা নিয়ে আলোচনা করেছিল।মৌসুমি বৃষ্টিপাত জুন মাসে শুরু হয়ে সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি শেষ হয়। তবে এবার সেপ্টেম্বরের শেষেও প্রবল বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে।সারা দেশে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। নেপাল আর্মি, নেপাল পুলিশ ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এ পর্যন্ত ৪,০০০ জনেরও বেশি
ঘূর্ণিঝড় ‘আসনা’ সরলেও গুজরাতের দুর্ভোগের শেষ নেই! কবে ফিরবে স্বাভাবিক জীবন?
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তবে এখনও অনেক এলাকায় উদ্ধারকাজ চলছে। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
নেপালের জাতীয় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (NDRRMA) প্রধান অনিল পোখরেল বলেছেন, “আমরা সব ধরনের সম্পদ ব্যবহার করে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তবে কিছু দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো কঠিন হচ্ছে।”
বন্যা ও ভূমিধসের কারণে দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষি, পর্যটন ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক কৃষক তাদের সমস্ত ফসল হারিয়েছেন। পর্যটন খাতে এই মৌসুমে বড় ধরনের লোকসান হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নেপালের অর্থমন্ত্রী যুবরাজ খাতিওয়াদা বলেছেন, “আমরা এখনও পুরো ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাইনি। তবে প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, এই দুর্যোগের কারণে দেশের অর্থনীতিতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নেপাল সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করছি। এছাড়া বন্যা ও ভূমিধস প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নেপালকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশ ত্রাণ সামগ্রী ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাও উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়্গ প্রসাদ শর্মা ওলি বলেছেন, “এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমি সকল নাগরিককে ধৈর্য ধরতে এবং একে অপরকে সাহায্য করতে অনুরোধ করছি। আমরা এই কঠিন সময় অতিক্রম করব।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু সরকারি প্রচেষ্টায় এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা কঠিন। তারা জোর দিচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপর।
নেপালের জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. মাধব কার্কি বলেছেন, “আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আরও বেশি প্রস্তুত হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।”
এদিকে, বন্যা ও ভূমিধসের কারণে নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা বন্যা কবলিত এলাকায় চিকিৎসা দল পাঠিয়েছি। জলবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
এই পরিস্থিতিতে নেপালের জনগণের মধ্যে একতা ও সহযোগিতার মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
নেপালের এক যুব নেতা রমেশ পৌডেল বলেছেন, “এই দুর্যোগ আমাদের একতাবদ্ধ করেছে। আমরা সবাই মিলে এই সংকট মোকাবেলা করব।”
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নেপালের মতো দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আরও বেশি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয় অঞ্চলে চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।”
নেপালের এই বন্যা ও ভূমিধস পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও ভালভাবে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।
নেপালের এই দুর্যোগ প্রমাণ করে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে। এটি শুধু নেপালের নয়, সারা বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা না নিলে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগের ঘটনা আরও বাড়তে পারে।
শেষ পর্যন্ত, নেপালের এই বন্যা ও ভূমিধস পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়ন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তবেই আমরা ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমাতে পারব।