নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) তার পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এই পদত্যাগ এসেছে সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেলের পরামর্শের পর, যিনি ওলিকে বলেছিলেন যে শুধুমাত্র তার পদত্যাগের মাধ্যমেই দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা সম্ভব। এর আগে সোমবার থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদে কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছিল এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছিল।
ক্ষমতায় থাকাকালীন ওলি সরকারের সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। প্রতিবাদকারীরা পার্লামেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং বিভিন্ন মন্ত্রীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে ওলি রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেলের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
সেনাপ্রধানের সাথে আলোচনায় ওলি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল সিগদেল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাধ্যমেই সেনাবাহিনী দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারবে। সূত্রের মতে, সেনাবাহিনী ওলির পদত্যাগের পর হস্তক্ষেপ করতে প্রস্তুত রয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই প্রতিবাদকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশ করে এবং তার ব্যক্তিগত বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেল, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, পুষ্প কমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’সহ বিভিন্ন নেতার বাসভবনও আক্রমণের শিকার হয়। প্রতিবাদকারীরা “কেপি চোর, দেশ ছোড়” (কেপি চোর, দেশ ছাড়) স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ওলি দুবাই পালানোর পরিকল্পনা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি চিকিৎসার অজুহাতে দুবাই যাওয়ার জন্য হিমালয় এয়ারলাইনসকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এমনকি তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই প্রতিবাদের পটভূমি তৈরি হয়েছিল গত সপ্তাহে সরকারের সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এক্স (টুইটার), হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সরকার বলেছিল যে এসব প্ল্যাটফর্ম সরকারি নির্দেশনা মেনে রেজিস্ট্রেশন করেনি। কিন্তু এই পদক্ষেপ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
জেন জেড নামে পরিচিত এই তরুণ প্রতিবাদকারীরা সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। নেপালের প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং ৩৬ লক্ষ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী এই নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
সোমবারের প্রতিবাদে পুলিশ বাহিনী রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান ব্যবহার করেছিল। কাঠমান্ডুতে ১৭ জন এবং ইতাহারিতে ২ জন মিলে মোট ১৯ জন প্রতিবাদকারী নিহত হয়। এছাড়াও ৪০০ এরও বেশি মানুষ আহত হয়েছিল, যার মধ্যে ২৮ জন পুলিশ সদস্যও ছিল।
এই সহিংসতার পর গৃহমন্ত্রী রমেশ লেখক সোমবার সন্ধ্যায় নৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে পদত্যাগ করেন। তার পাদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষিমন্ত্রী রামনাথ অধিকারী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রদীপ পৌডেলও পদত্যাগ করেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির ২১ জন সংসদ সদস্য গণপদত্যাগ করেছেন।
প্রতিবাদের চাপে সরকার সোমবার রাতেই সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং মঙ্গলবার সকালে ঘোষণা করেন যে সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং সেগুলো আবার চালু রয়েছে। তবুও প্রতিবাদকারীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল।
কাঠমান্ডু, ললিতপুর এবং ভক্তপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছিল। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বাতিল করে দেওয়া হয় এবং বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী কাঠমান্ডুর রাস্তায় মোতায়েন করা হয়েছিল।
নেপালি কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগন থাপা ওলির অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। দলটির প্রবীণ নেতারা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে জাতীয় সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এই রাজনৈতিক সংকট নেপালের প্রতিবেশী ভারতের জন্যও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সশস্ত্র সীমান্ত বল (এসএসবি) নেপাল-ভারত সীমান্তে সতর্কতা বৃদ্ধি করেছে। ১৭৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্তে উত্তরাখণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিম রাজ্য জুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ওলির পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, “দেশে বিরাজমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সাংবিধানিক রাজনৈতিক সমাধান ও সমস্যা নিরসনের দিকে আরও উদ্যোগ নেওয়ার সুবিধার্থে আমি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৭(১)(ক) অনুযায়ী আজ থেকে কার্যকর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করছি”।
তার এই পদত্যাগ নেপালি রাজনীতিতে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। ২০১৫-১৬, ২০১৮-২১ এবং ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ওলির এবারের পদত্যাগ হিমালয়ের এই দেশে তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক শক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নেপালের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বিশেষত চীন ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত এই কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করতে পারে।
আগামী দিনে নেপালে কী ধরনের সরকার গঠিত হবে এবং তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে কেমন হবে, সেটি দেখার বিষয়। তবে এটি স্পষ্ট যে নেপালের রাজনীতিতে প্রথাগত দলগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।