৩০ লাখ টাকার জন্য বিমান অপহরণ! নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলার স্বামী দূর্গাপ্রসাদ সুবেদীর চমকে দেওয়া কালো অতীত

নেপালের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির জীবনে এক অভাবনীয় অধ্যায়ের খোঁজ মিলেছে। যিনি বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সে দেশটির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তার স্বামী দূর্গাপ্রসাদ সুবেদী ১৯৭৩ সালে…

Riddhi Datta

 

নেপালের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির জীবনে এক অভাবনীয় অধ্যায়ের খোঁজ মিলেছে। যিনি বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সে দেশটির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তার স্বামী দূর্গাপ্রসাদ সুবেদী ১৯৭৩ সালে নেপালের ইতিহাসের প্রথম বিমান অপহরণে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই অপহরণের পিছনে ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাত্র ৩০ লক্ষ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা।

জেন জি আন্দোলনের চাপে কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের পর গত ১২ সেপ্টেম্বর নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন সুশীলা কার্কি। তার এই নিয়োগের পরই আলোচনায় এসেছে তার স্বামীর রোমহর্ষক অতীত, যা নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

বিমান অপহরণের অভূতপূর্ব ঘটনা

১৯৭৩ সালের ১০ জুন সকাল সাড়ে আটটায় নেপালের বিরাটনগর বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে উড়ান দিয়েছিল রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের একটি ১৯ আসনের কানাডা নির্মিত DHC-6 টুইন অটার বিমান। বিমানে ছিলেন মোট ২২ জন – ১৯ জন যাত্রী এবং তিন জন ক্রু সদস্য। যাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত ছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মালা সিনহা ও তার স্বামী নেপালি অভিনেতা সিপি লোহানি।

টেক অফের কিছুক্ষণ পরেই তিন যাত্রী আচমকা পিস্তল ও গ্রেনেড বের করে পাইলট কেবিনে প্রবেশ করেন। এই তিনজন ছিলেন দূর্গাপ্রসাদ সুবেদী, বসন্ত ভট্টরাই এবং নাগেন্দ্র প্রসাদ ধুঙ্গেল। পিস্তলের মুখে পাইলটকে নির্দেশ দেওয়া হয় বিমানটি বিহারের ফরবেসগঞ্জে অবতরণ করানোর জন্য। পাইলট কোনোরকমে ঘাসজমির উপর বিমানটি নামাতে সক্ষম হন।

রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অর্থ সংগ্রহের অভিনব পথ

এই বিমান অপহরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজা মহেন্দ্রের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহ। বিমানে নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ৩০ লক্ষ টাকা (ভারতীয় নোটে) ছিল, যা ছিল অপহরণকারীদের প্রকৃত লক্ষ্য। ফরবেসগঞ্জে অবতরণের পর পাঁচজন সহযোগী সেখানে অপেক্ষা করছিল। তারা দ্রুত তিনটি বাক্স ভর্তি টাকা বিমান থেকে নামিয়ে নেয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, অপহরণকারীরা কোনো যাত্রীর ক্ষতি করেনি। টাকা নামিয়ে নেওয়ার পর বিমানটিকে আবার উড়তে দেওয়া হয় এবং সকল যাত্রী নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছান। লুটের টাকা সড়কপথে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়।

গিরিজা প্রসাদ কৈরালার মাস্টারপ্ল্যান

এই পুরো অপহরণ পরিকল্পনার মূল স্থপতি ছিলেন পরবর্তী সময়ের নেপালের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। দূর্গাপ্রসাদ সুবেদী ছিলেন কৈরালার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও নেপালি কংগ্রেসের তরুণ নেতা। সুবেদী তখন সদ্য কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৩৫১ অপহরণের ঘটনা পড়ে এই ধারণা পান।

পরিকল্পনায় আরও জড়িত ছিলেন ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাও, যিনি ফরবেসগঞ্জে অপেক্ষমাণ সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্র উৎখাত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।

গ্রেফতার ও মুক্তি

ঘটনার কিছুদিন পরেই বেশিরভাগ অপহরণকারী ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েন। দূর্গাপ্রসাদ সুবেদী কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও পরে গ্রেফতার হন এবং দুই বছরের কারাদণ্ড পান। ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থার সময় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

সুশীলা কার্কির আজকের অবস্থান

বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সী সুশীলা কার্কি নেপালের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯৫২ সালের ৭ জুন বিরাটনগরে জন্ম নেওয়া সুশীলা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় দূর্গাপ্রসাদ সুবেদীর সাথে পরিচিত হন এবং পরে তাকে বিয়ে করেন।

সুশীলা ২০১৬ সালে নেপালের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার বিচারিক জীবনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান এবং সাহসী রায়ের জন্য তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব এনেছিল মাওবাদী ও নেপালি কংগ্রেস, কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে তা প্রত্যাহার করতে হয়।

ভারতের সাথে সম্পর্ক

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই সুশীলা কার্কি ভারতের প্রতি তার ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নমস্কার জানিয়ে বলেছিলেন, “মোদিকে আমি নমস্কার জানাই। আমি তাঁকে সম্মান করি। ভারতের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং স্নেহ রয়েছে। কারণ, তারা সর্বদা নেপালের পাশে থেকেছে”।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

সুশীলার প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এর ফলে নেপালে শান্তি ও সুস্থিতা ফিরবে”। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এক্স প্ল্যাটফর্মে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য

১৯৭৩ সালের এই বিমান অপহরণ নেপালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে কীভাবে অতীতের রাজনৈতিক সংগ্রাম আজকের নেপালি রাজনীতির সাথে জড়িত। যে বিমানটি অপহরণ করা হয়েছিল, সেটি আরও চল্লিশ বছর উড়েছে এবং ২০১৪ সালে একটি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হওয়ার পর এর ধ্বংসাবশেষ কাঠমান্ডুর একটি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।

সুশীলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার অতীত এবং বর্তমানের এই সংযোগ নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যেখানে একদিকে তার স্বামী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিমান অপহরণের মতো চরম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেখানে আজ তার স্ত্রী সেই গণতান্ত্রিক নেপালের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের হাল ধরেছেন।

About Author
Riddhi Datta

ঋদ্ধি দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, যিনি জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তোলেন। তাঁর লেখায় রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। ঋদ্ধি নিয়মিতভাবে এই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ, গবেষণা সারসংক্ষেপ এবং বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।