নতুন GST চালু হচ্ছে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে: সস্তা হচ্ছে বহু জিনিস, দাম বাড়ছে বিলাসবহুল পণ্যের! জানুন বিস্তারিত

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। ভারতীয় কর ব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক সংস্কার আসতে চলেছে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ থেকে। ৫৬তম জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশে চালু হতে চলেছে এক নতুন, সরলীকৃত…

Avatar

 

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। ভারতীয় কর ব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক সংস্কার আসতে চলেছে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ থেকে। ৫৬তম জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশে চালু হতে চলেছে এক নতুন, সরলীকৃত Goods and Services Tax (GST) ব্যবস্থা। পুরনো চার-স্তরীয় (৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%) করের কাঠামোর পরিবর্তে अब থেকে দুটি প্রধান স্তর—৫% ও ১৮%—এবং বিলাসবহুল ও ক্ষতিকারক (demerit) পণ্যের জন্য একটি নতুন ৪০% স্তর কার্যকর হবে।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের মতে, এই নতুন কর ব্যবস্থা শুধুমাত্র দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে না, বরং সাধারণ মানুষের হাতে আরও বেশি নগদ টাকা এনে দেবে, যার ফলে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা অর্থনীতিতে নতুন করে সঞ্চারিত হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু পণ্যের দাম কমতে চলায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি বড়সড় স্বস্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আসুন, এই নতুন GST ব্যবস্থা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

নতুন GST ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য

২০১৭ সালে “এক দেশ, এক কর” স্লোগান নিয়ে জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকে এটিই সবচেয়ে বড় সংস্কার। গত কয়েক বছরে একাধিক করের স্তর এবং জটিল নিয়মকানুনের কারণে ব্যবসা ও উপভোক্তা, উভয় পক্ষকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সমস্যা দূর করতে এবং কর ব্যবস্থাকে আরও সরল ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে জিএসটি কাউন্সিল এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যগুলি হল:

  • কর কাঠামোর সরলীকরণ: চারটি স্তরের পরিবর্তে দুটি প্রধান স্তর থাকায় করের হিসাব রাখা এবং কমপ্লায়েন্সের বোঝা অনেকটাই কমবে।
  • দ্রব্যমূল্য হ্রাস: বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্যের ওপর করের হার কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা।
  • চাহিদা বৃদ্ধি: মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে বাজারে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করা, যা অর্থনীতিকে গতি দেবে।
  • ব্যবসার সুবিধা: সরল কর ব্যবস্থা ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের (MSMEs) জন্য ব্যবসা করা আরও সহজ করে তুলবে।

দ্য হিন্দু-র রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ইতিমধ্যেই সেন্ট্রাল জিএসটি (CGST)-র নতুন হারগুলির বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে এবং রাজ্যগুলিকেও স্টেট জিএসটি (SGST) সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কোন জিনিসের দাম কমছে, আর কোনটির বাড়ছে? (Latest Updates & Statistics)

এই নতুন Goods and Services Tax (GST) ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে করের হারে। বহু পণ্যকে উচ্চ করের স্তর থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।

যেসব পণ্যের দাম কমতে চলেছে (৫% এবং ১৮% স্তরে):

পণ্য/পরিষেবা পুরনো GST হার নতুন GST হার (২২ সেপ্টেম্বর থেকে)
দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী
মাখন, ঘি, চিজ, পনির ১২% ৫%
শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, সাবান, হেয়ার অয়েল ১৮% ৫%
প্যাকেজড খাদ্য (বিস্কুট, পাস্তা, কর্নফ্লেক্স) ১২% বা ১৮% ৫%
মশলা, জ্যাম, সস, স্যুপ ১২% বা ১৮% ৫%
ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালীর সামগ্রী
টিভি (৩২ ইঞ্চি পর্যন্ত), ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিন ২৮% ১৮%
মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার ১৮% ১৮% (অপরিবর্তিত)
বাসনপত্র, সাইকেল, রান্নাঘরের সরঞ্জাম ১২% বা ১৮% ৫%
যানবাহন
ছোট গাড়ি (1200cc পেট্রোল/1500cc ডিজেলের কম) ২৮% + সেস ১৮%
মোটরসাইকেল (350cc পর্যন্ত) ২৮% ১৮%
বাণিজ্যিক যানবাহন (বাস, ট্রাক) ২৮% ১৮%
অন্যান্য
সিমেন্ট ২৮% ১৮%
হোটেল (ভাড়া ₹৭,৫০০ পর্যন্ত) ১২% ৫%
জীবন বিমা এবং স্বাস্থ্য বিমা ১৮% করমুক্ত (কিছু ক্ষেত্রে)
লেখার চক, টেইলার্স চক ১২% ০% (করমুক্ত)


যেসব পণ্যের দাম বাড়তে চলেছে (নতুন ৪০% স্তর):

এই সংস্কারে বিলাসবহুল এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক পণ্যগুলিকে একটি নতুন ৪০% করের স্তরে আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • বড় বা বিলাসবহুল গাড়ি: 1500cc-র বেশি ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ি এবং SUV।
  • দামি মোটরসাইকেল: 350cc-র বেশি ইঞ্জিনযুক্ত বাইক।
  • তামাক ও তামাকজাত পণ্য: সিগারেট, পান মশলা ইত্যাদি।
  • অ্যারিয়েটেড ড্রিঙ্কস: সোডা এবং অন্যান্য কার্বোনেটেড পানীয়।

তবে কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। যেমন, এতদিন পর্যন্ত ছাপানো বই করমুক্ত থাকলেও, এবার “আনকোটেড পেপার” বা ছাপার কাগজের ওপর ১৮% জিএসটি ধার্য হওয়ায় বইয়ের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইভাবে, কলম এবং স্কুল ব্যাগের মতো শিক্ষাসামগ্রীর ওপরও ১৮% জিএসটি বসানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞের মতামত এবং অর্থনৈতিক প্রভাব

দেশের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই নতুন Goods and Services Tax (GST) ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন। CRISIL-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডি.কে. যোশীর মতে, এই পদক্ষেপে সাধারণ পরিবারের খরচের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকা পণ্যগুলির দাম কমবে, যা সরাসরি ভোগ বা চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে। দি ইকোনমিক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কম মূল্যস্ফীতি এবং আয়করে ছাড়ের পাশাপাশি জিএসটি হার কমানো মধ্যবিত্তের জন্য একটি “ট্রিপল টেলউইন্ড” বা ত্রিফলাসুবিধা হিসাবে কাজ করতে পারে।

অন্যদিকে, Edelweiss Mutual Fund-এর CIO ত্রিদীপ ভট্টাচার্য মনে করেন, এই সংস্কার ভারতীয় শেয়ার বাজারের জন্য একটি বড় “ট্রিগার” হতে পারে, যা অটো, ভোগ্যপণ্য এবং অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির আয়ে বড় ধরনের বৃদ্ধি ঘটাবে।

তবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই কর হ্রাসের সুবিধা যাতে বিক্রেতারা উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়, তা নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যেই সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (CBIC) একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে যে, ২২ সেপ্টেম্বরের আগে তৈরি হওয়া এবং অবিক্রিত থাকা পণ্যের ওপর নতুন MRP-র স্টিকার লাগাতে হবে।

নতুন GST হার কীভাবে জানবেন?

সরকার সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য জিএসটি হার জানার প্রক্রিয়াটিকে অত্যন্ত সহজ করেছে। যেকোনো উপভোক্তা বা ব্যবসায়ী কয়েকটি সহজ উপায়ে সঠিক জিএসটি হার যাচাই করতে পারেন:

১. অফিসিয়াল CBIC-GST ওয়েবসাইট: যেকোনো পণ্যের সঠিক জিএসটি হার জানার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হল CBIC-GST পোর্টাল। এখানে পণ্য বা পরিষেবার নাম অথবা HSN (Harmonized System of Nomenclature) কোড দিয়ে সার্চ করলেই নতুন এবং পুরনো হার জানা যাবে।

২. ‘GST Rate Finder’ মোবাইল অ্যাপ: ভারত সরকার দ্বারা নির্মিত এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি Android এবং iOS উভয় প্ল্যাটফর্মেই উপলব্ধ। অ্যাপটি ডাউনলোড করে খুব সহজেই যেকোনো পণ্যের জিএসটি হার খুঁজে বের করা যায়।

৩. FMCG সংস্থাগুলির ওয়েবসাইট: নতুন দাম কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে প্রধান সংস্থাগুলি তাদের ওয়েবসাইটে সংশোধিত মূল্য তালিকা প্রকাশ করবে।

ভবিষ্যতের পথ এবং সুপারিশ

এই নতুন Goods and Services Tax (GST) সংস্কার ভারতের অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে:

  • ব্যবসায়ীরা কর কমার সুবিধা পুরোপুরি উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
  • প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো, বিশেষ করে জিএসটি নেটওয়ার্ক (GSTN), যেন মসৃণভাবে এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারে।
  • নতুন নিয়মকানুন সম্পর্কে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

১. নতুন জিএসটি হার কবে থেকে কার্যকর হবে?

নতুন জিএসটি হারগুলি আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, সোমবার থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে।

২. কোন কোন জিএসটি স্ল্যাব উঠে যাচ্ছে?

১২% এবং ২৮% এই দুটি জিএসটি স্ল্যাব তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে প্রধানত ৫% এবং ১৮%—এই দুটি স্ল্যাব থাকবে।

৩. বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর কি বাড়ছে?

হ্যাঁ, বড় গাড়ি, দামি বাইক এবং তামাকজাত পণ্যের মতো বিলাসবহুল এবং ডিমেরিট (demerit) পণ্যের ওপর একটি নতুন ৪০% করের স্তর আরোপ করা হয়েছে।

৪. সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কোন জিনিসগুলি সবচেয়ে বেশি সস্তা হবে?

মাখন, ঘি, পনির, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ছোট গাড়ি, বাইক, টিভি, ফ্রিজ এবং সিমেন্টের মতো বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

৫. আমি কীভাবে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের নতুন জিএসটি হার জানতে পারি?

আপনি CBIC-GST-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (cbic-gst.gov.in) অথবা সরকারের ‘GST Rate Finder’ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে যেকোনো পণ্যের সঠিক ও আপ-টু-ডেট জিএসটি হার জানতে পারবেন।

৬. বই এবং খাতার দাম কি বাড়বে?

ছাপার কাগজের ওপর ১৮% জিএসটি ধার্য হওয়ায় বইয়ের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। এছাড়া কলম ও স্কুল ব্যাগের দামও বাড়তে পারে। তবে লেখার চক এবং টেইলার্স চককে করমুক্ত করা হয়েছে।

 

২২ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হতে চলা নতুন Goods and Services Tax (GST) ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ। কর কাঠামোর সরলীকরণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর মাধ্যমে এটি একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে, তেমনই অন্যদিকে অর্থনীতিকে একটি নতুন গতি দেবে। এখন দেখার বিষয়, এই সংস্কারের সুফল কতটা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছায়। উপভোক্তা হিসাবে আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা যেন কেনাকাটার সময় নতুন ও হ্রাসপ্রাপ্ত দামের সুবিধাই পাই।

 

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম