জিএসটি কাউন্সিলের ৫৬তম বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য সুখবর নিয়ে এল কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘ আলোচনার পর ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে জিএসটি কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বুধবার অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বর্তমান চারটি স্ল্যাবের পরিবর্তে মাত্র দুটি প্রধান স্ল্যাব রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন যে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন জিএসটি কাঠামো কার্যকর হবে। এতে ৫% ও ১৮% এই দুটি প্রধান স্ল্যাব থাকবে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যে সব পণ্য ১২% স্ল্যাবে রয়েছে তার ৯৯% এখন ৫% স্ল্যাবে চলে যাবে। আর ২৮% স্ল্যাবের ৯০% পণ্য ১৮% স্ল্যাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে ব্যাপক স্বস্তি
দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রে উল্লেখযোগ্য স্বস্তি পাবেন ভোক্তারা। টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, চুলের তেল, সাবান, টুথব্রাশ, সাইকেল, রান্নাঘরের পাত্র ও গৃহস্থালীর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে এখন মাত্র ৫% জিএসটি হবে। এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক খরচে উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় হবে।
খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও ভালো খবর রয়েছে। UHT দুধ, পনির ও চিনার উপর থেকে জিএসটি সম্পূর্ণ তুলে নেওয়া হয়েছে। মাখন, চিজ, পাস্তা, আইসক্রিম, ফলের রস, নারকেল পানি, খাখরা, পিৎজা ব্রেডের মতো খাদ্যসামগ্রীতে জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে।
গাড়ি-বাইক কিনতে চান? এখনই সময়
অটোমোবাইল সেক্টরে রয়েছে বড় সুখবর। ১২০০ সিসি-র নিচে থাকা ছোট গাড়ি ও ৩৫০ সিসি-র নিচে থাকা মোটরসাইকেলে জিএসটি ২৮% থেকে কমে ১৮% হয়েছে। এর ফলে ১০ লাখ টাকার গাড়ি কিনলে প্রায় ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় হতে পারে। একইভাবে ১ লাখ টাকার বাইক কিনলে প্রায় ১০,০০০ টাকা সাশ্রয় হবে।
Maruti Alto, WagonR, Swift, Baleno, Tata Tiago, Hyundai i10, i20 এর মতো জনপ্রিয় গাড়িগুলোর দাম কমবে। একইভাবে এন্ট্রি লেভেল মোটরসাইকেলের ক্রেতারাও এই সুবিধা পাবেন।
গৃহস্থালী ইলেকট্রনিক্স পণ্য সস্তা
টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিনের মতো গৃহস্থালীর ইলেকট্রনিক্স পণ্যেও জিএসটি ২৮% থেকে কমে ১৮% হয়েছে। এর ফলে এই সব পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে, যা পুজোর মরসুমে ক্রেতাদের জন্য বড় স্বস্তি।
কৃষি ও টেক্সটাইল খাতে উপকার
কৃষি সেক্টরেও রয়েছে ভালো খবর। সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া, সার উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন এসিডের জিএসটি ১৮% ও ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে। এর ফলে কৃষকদের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
টেক্সটাইল সেক্টরেও স্বস্তি রয়েছে। সিন্থেটিক কাপড়, ফাইবার সুতো, কার্পেট, হাতে বোনা কাপড়ের জিএসটি ১২% থেকে কমে ৫% হয়েছে। ২৫০০ টাকার নিচে দামের পোশাক ও জুতার জিএসটি ৫% করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও বিমা খাতে স্বস্তি
স্বাস্থ্যসেবা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বয়স্কদের স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম থেকে জিএসটি তুলে নেওয়া হয়েছে। জীবনবিমা ও স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামের জিএসটিও কমানো হয়েছে। কিছু জীবনরক্ষাকারী ওষুধের হারও কমানো হয়েছে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম, থার্মোমিটার, ক্লিনিক্যাল ডায়াপারের জিএসটি কমে গেছে। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমবে।
স্টেশনারি ও শিক্ষা উপকরণে ছাড়
শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে সুখবর। রাবার, ইরেজার থেকে সম্পূর্ণ জিএসটি তুলে নেওয়া হয়েছে। ম্যাপ, চার্ট, নোটবুক, অ্যাটলাসের জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে।
পরিবেশ বান্ধব পণ্যে প্রণোদনা
পরিবেশ রক্ষায় সরকারের অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয়েছে নতুন জিএসটি কাঠামোয়। সোলার কুকারের জিএসটি ১২% থেকে কমে ৫% হয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির সরঞ্জামগুলোরও জিএসটি কমানো হয়েছে।
বিলাসবহুল ও ক্ষতিকর পণ্যে বেশি কর
নতুন কাঠামোয় একটি বিশেষ ৪০% স্ল্যাব রাখা হয়েছে মাত্র ৫-৭টি পণ্যের জন্য। সিগারেট, তামাকজাত পণ্য, পানমশলা, গুটকা এবং বিলাসবহুল গাড়ির জন্য এই উচ্চ হার প্রযোজ্য থাকবে। তবে তামাকজাত পণ্যে বর্তমান জিএসটি হার ও ক্ষতিপূরণ সেস ততক্ষণ বহাল থাকবে যতক্ষণ না ক্ষতিপূরণ সেস অ্যাকাউন্টের সমস্ত ঋণ ও সুদ পরিশোধ হয়।
আর্থিক প্রভাব ও রাজস্ব হ্রাস
নতুন কাঠামোর ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের রাজস্ব হ্রাস পাবে। অনুমান করা হচ্ছে মোট রাজস্ব হ্রাস হতে পারে প্রায় ৯৩,০০০ কোটি টাকা। কিছু বিরোধী দলশাসিত রাজ্য এই রাজস্ব ক্ষতির ক্ষতিপূরণ চেয়েছে।
কার্যকর গড় জিএসটি হার, যা ২০১৭ সালে চালুর সময় ১৪.৪% থেকে ২০১৯ সালে কমে ১১.৬% হয়েছিল, এখন আরও কমে ৯.৫% হতে পারে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে প্রাথমিকভাবে রাজস্ব কমলেও পরবর্তীতে তা দ্রুত পুনরুদ্ধার হয় এবং প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহ হয়।
এমএসএমই ও স্টার্টআপদের সুবিধা
ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই) এবং স্টার্টআপদের জন্য রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। যেসব ব্যবসার মাসিক ট্যাক্স আড়াই লক্ষ টাকার বেশি নয়, তাদের রেজিস্ট্রেশন এখন মাত্র ৩ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
রপ্তানি রিফান্ড দ্রুততর
রপ্তানিকারকদের জন্য সুখবর হলো রিফান্ড প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়েছে। ৭ দিনের মধ্যে রপ্তানি রিফান্ড ইশু করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টেক্সটাইল, ফার্মা, রাসায়নিক ও সার শিল্পের আটকে থাকা রিফান্ডও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
এই ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে সরকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। তিনি বলেছিলেন “এই দিওয়ালি আমি আপনাদের জন্য ডবল দিওয়ালি করে দিতে চাই”। নতুন জিএসটি কাঠামোর ফলে সাধারণ মানুষের করের বোঝা কমবে, ভোগ বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতি আরও সচল হবে।
