নবজাতকের জন্য কেনাকাটা: সাধ ও সাধ্যের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও বাজেট সহায়িকা (২০২৫)

নতুন অতিথির আগমনে প্রতিটি পরিবারে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। এই আনন্দময় প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নবজাতকের জন্য কেনাকাটা। প্রথমবারের মতো বাবা-মা হচ্ছেন যারা, তাদের জন্য এই কাজটি বেশ কঠিন…

মনীষা মুখার্জী

 

নতুন অতিথির আগমনে প্রতিটি পরিবারে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। এই আনন্দময় প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নবজাতকের জন্য কেনাকাটা। প্রথমবারের মতো বাবা-মা হচ্ছেন যারা, তাদের জন্য এই কাজটি বেশ কঠিন ও বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কী কিনবেন, কতটা কিনবেন, কোথা থেকে কিনবেন, আর বাজেটই বা কেমন হবে – এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। আপনাদের এই পথচলাকে সহজ করতে আজ আমরা নিয়ে এসেছি একটি বিস্তারিত, তথ্যবহুল এবং বাস্তবসম্মত ‘নবজাতকের জন্য কেনাকাটা লিস্ট’ ও বাজেট নির্দেশিকা।

নবজাতকের কেনাকাটা: কখন শুরু করবেন?

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (৪-৬ মাস) থেকেই ধীরে ধীরে কেনাকাটা শুরু করা বুদ্ধিমানের কাজ। এই সময়ে শারীরিক শক্তি ও মানসিক উৎসাহ দুটোই তুঙ্গে থাকে। শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়ো এড়াতে একটি তালিকা তৈরি করে অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে ফেলুন। এতে বাজেট নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হয়।

ক্যাটাগরি অনুযায়ী নবজাতকের প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা

নবজাতকের বিশাল চাহিদার কথা মাথায় রেখে, আমরা কেনাকাটার তালিকাটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছি। এতে আপনার প্রয়োজনীয় পণ্য খুঁজে পেতে এবং বাজেট পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে।

১. পোশাক-পরিচ্ছদ (Clothing): আরামকে দিন সর্বোচ্চ গুরুত্ব

নবজাতকের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়, তাই তাদের জন্য সুতির নরম কাপড়ের পোশাকই সবচেয়ে উপযোগী। सिंथेटिक বা ভারী কাপড়ের পোশাক এড়িয়ে চলুন।

  • নিমা/ফতুয়া: ৮-১০টি (সহজে পরানো ও খোলানো যায়)
  • স্লিপস্যুট/বডিস্যুট: ৪-৬টি (গরমের দিনে আরামদায়ক)
  • পায়জামা: ৪-৬টি
  • মোজা ও মিটেন (হাতমোজা): ৩-৪ জোড়া (শিশুর নখের আঁচড় থেকে বাঁচায়)
  • টুপি: ২-৩টি (কান ও মাথা সুরক্ষিত রাখে)
  • কাঁথা: পাতলা সুতির ৮-১০টি, কিছুটা মোটা ৪-৫টি (শিশুকে জড়িয়ে রাখার জন্য ও বিছানায় ব্যবহারের জন্য)
  • র‍্যাপিং ক্লথ/সোয়াডেল (Swaddle): ২-৩টি (শিশুকে উষ্ণ ও সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে)
  • তোয়ালে: নরম কাপড়ের ২-৩টি (হুডিসমেত হলে ভালো)

বিশেষ টিপস: ঋতু অনুযায়ী পোশাক কিনুন। গরমকালে জন্মানো শিশুর জন্য পাতলা সুতির কাপড় এবং শীতকালে জন্মানো শিশুর জন্য ফ্লানেল বা উলের নরম পোশাক প্রয়োজন হবে। অতিরিক্ত পোশাক কেনা থেকে বিরত থাকুন, কারণ শিশুরা খুব দ্রুত বড় হয়।

২. ডায়াপারিং (Diapering): পরিচ্ছন্নতা ও স্বস্তি

ডায়াপার নবজাতকের জন্য একটি অপরিহার্য পণ্য। আপনার পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী ডিসপোজেবল বা কাপড়ের ডায়াপার বেছে নিতে পারেন।

  • ডায়াপার: নবজাতকের সাইজের (Newborn size) ২-৩ প্যাকেট (শুরুতে বেশি না কেনাই ভালো, কারণ ওজন দ্রুত বাড়ে)
  • কাপড়ের ন্যাপি: ১২-২৪টি (যদি কাপড়ের ডায়াপার ব্যবহার করতে চান)
  • ওয়েট টিস্যু/ওয়াইপস: ১-২ প্যাকেট (সেনসিটিভ স্কিনের জন্য ওয়াটার-বেসড ওয়াইপস বেছে নিন)
  • ডায়াপার র‍্যাশ ক্রিম: ১টি (চিকিৎসকের পরামর্শে ভালো মানের র‍্যাশ ক্রিম কিনুন)
  • চেঞ্জিং ম্যাট: ২টি (ওয়াটারপ্রুফ হলে ময়লা পরিষ্কার করা সহজ)
  • কটন বল/পাতলা সুতির কাপড়: শিশুর গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করার জন্য।
  • ময়লা ফেলার বিন: ঢাকনাসহ একটি বিন।

পরিসংখ্যান বলছে: একটি নবজাতকের দিনে প্রায় ৮-১২টি ডায়াপার প্রয়োজন হতে পারে। তাই এই খাতে খরচের একটি ভালো হিসাব রাখা জরুরি।

৩. গোসল ও প্রসাধনী (Bathing & Grooming): কোমল যত্ন

নবজাতকের ত্বকের যত্নে বিশেষভাবে তৈরি পণ্য ব্যবহার করা উচিত। কেমিক্যালযুক্ত বা তীব্র সুগন্ধিযুক্ত পণ্য এড়িয়ে চলুন।

  • বেবি বাথ টাব: ১টি
  • বেবি সোপ/বডি ওয়াশ: (pH-neutral ও টিয়ার-ফ্রি ফর্মুলাযুক্ত)
  • বেবি শ্যাম্পু: (টিয়ার-ফ্রি)
  • বেবি অয়েল/লোশন: (ত্বককে আর্দ্র রাখতে)
  • নরম তোয়ালে: ২-৩টি
  • ওয়াশ ক্লথ (Washcloth): ৪-৬টি (ছোট নরম রুমাল)
  • বেবি নেইল কাটার/ المقص: ১টি
  • নরম চুলের ব্রাশ/চিরুনি: ১টি
  • ন্যাসাল অ্যাসপিরেটর (Nasal Aspirator): (নাক পরিষ্কার করার জন্য)

বিশেষজ্ঞদের মতে: শিশুর জন্মের ৭২ ঘণ্টা পর প্রথম গোসল করানো উচিত। গোসলের পানির তাপমাত্রা মায়ের কনুই দিয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। শিশুর ত্বকের সুরক্ষায় প্রাকৃতিক উপাদানযুক্ত পণ্য বেছে নিতে পারেন। আরও তথ্যের জন্য ইউ ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর প্যারেন্টিং গাইড দেখতে পারেন।

৪. খাওয়ানো (Feeding): মায়ের দুধই শ্রেষ্ঠ

জন্মের প্রথম ৬ মাস শিশুর জন্য মায়ের দুধই একমাত্র ও আদর্শ খাবার। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন হতে পারে।

  • ব্রেস্ট পাম্প: (কর্মজীবী মায়েদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়)
  • ফিডিং বোতল (BPA-free): ২-৩টি (যদি ফর্মুলা খাওয়ানোর প্রয়োজন হয়)
  • বোতল পরিষ্কার করার ব্রাশ ও লিকুইড ক্লিনার: ১টি করে
  • বিব (Bibs) ও বার্প ক্লথ (Burp Cloths): ৪-৬টি
  • নার্সিং কভার: (বাইরে বা অতিথিদের সামনে শিশুকে খাওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্য দেবে)
  • নার্সিং ব্রা ও ব্রেস্ট প্যাড: মায়েদের জন্য।
  • ফর্মুলা দুধ: (অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী)

৫. বিছানাপত্র ও ঘুমানোর সরঞ্জাম (Bedding & Sleep): নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ

নবজাতকের নিরাপদ ঘুমের পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

  • বিছানা/ক্রিব (Crib) বা বেসিনেট: ১টি (নিরাপদ ও মজবুত)
  • মশারি: ১টি (মশার উপদ্রব থেকে শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে)
  • ওয়াটারপ্রুফ ম্যাট/ অয়েল ক্লথ: ২টি (বিছানা ভেজার হাত থেকে বাঁচায়)
  • বিছানার চাদর: নরম সুতির ৪-৬টি
  • সরিষার বালিশ: (প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি শিশুর মাথার আকৃতি ঠিক রাখতে সাহায্য করে)
  • কোলবালিশ: ২টি (শিশুর দু’পাশে দিয়ে রাখলে সে নিরাপদ বোধ করে)

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: শিশুর বিছানায় অতিরিক্ত নরম কাঁথা, কম্বল বা খেলনা রাখা থেকে বিরত থাকুন। এটি সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (SIDS) এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৬. স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা (Health & Safety): জরুরি প্রস্তুতি

কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সরঞ্জাম হাতের কাছে রাখা ভালো।

  • ডিজিটাল থার্মোমিটার: ১টি
  • প্রাথমিক চিকিৎসার কিট: (ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, তুলা ইত্যাদি)
  • হ্যান্ড স্যানিটাইজার: (শিশুকে ধরার আগে ব্যবহারের জন্য)

৭. যাতায়াত ও অন্যান্য (Travel & Miscellaneous):

  • বেবি ক্যারিয়ার/স্লিং: ( শিশুকে নিয়ে হাঁটাচলার জন্য)
  • ডায়াপার ব্যাগ: ১টি (বাইরে যাওয়ার সময় শিশুর সব জিনিস একসাথে রাখার জন্য)
  • গরম পানির ফ্লাস্ক: ১টি
  • ছোট খেলনা (Rattles): কয়েকটি (শিশুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য)

বাজেট কেমন হতে পারে? একটি আনুমানিক ধারণা

বাংলাদেশে নবজাতকের জন্য কেনাকাটার বাজেট অনেকটাই নির্ভর করে আপনার পছন্দ, ব্র্যান্ড এবং জীবনযাত্রার মানের উপর। তবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি আনুমানিক ধারণা নিচে দেওয়া হলো:

  • পোশাক-পরিচ্ছদ: ৩,০০০ – ৬,০০০ টাকা
  • ডায়াপারিং: ২,০০০ – ৪,০০০ টাকা (মাসিক)
  • গোসল ও প্রসাধনী: ১,৫০০ – ৩,০০০ টাকা
  • খাওয়ানোর সরঞ্জাম: ২,০০০ – ৫,০০০ টাকা (ব্রেস্ট পাম্পসহ)
  • বিছানাপত্র ও অন্যান্য: ৫,০০০ – ১০,০০০ টাকা (ক্রিব বাদে)
  • স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা: ১,০০০ – ২,০০০ টাকা

মোট আনুমানিক খরচ (এককালীন): ১২,৫০০ – ৩০,০০০ টাকা।

বিঃদ্রঃ এই খরচ একটি সাধারণ ধারণা মাত্র। স্থান, দোকান এবং ব্র্যান্ডভেদে দামের তারতম্য হতে পারে।

স্মার্ট কেনাকাটার কিছু টিপস

  • তালিকা তৈরি করুন: কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করুন।
  • অফারের খোঁজ নিন: বিভিন্ন সুপারশপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রায়ই বেবি প্রোডাক্টের উপর ছাড় দেওয়া হয়।
  • উপহারের জন্য অপেক্ষা করুন: আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক কিছুই উপহার হিসেবে পেতে পারেন। তাই দামী বা শৌখিন জিনিস কেনার আগে কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারেন।
  • প্রয়োজনীয়তা বনাম বিলাসিতা: কোনটি আপনার শিশুর জন্য সত্যিই দরকারি এবং কোনটি শুধুমাত্র শৌখিনতা, তা বোঝার চেষ্টা করুন।
  • গুণগত মান: কম দামের চেয়ে পণ্যের গুণগত মানের উপর বেশি জোর দিন, বিশেষ করে ত্বক ও স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে।

শিশুর আগমন আপনার জীবনে নিয়ে আসুক অনাবিল আনন্দ ও সুখ। সঠিক পরিকল্পনা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কেনাকাটা করলে এই প্রস্তুতির পর্বটিও হয়ে উঠবে আনন্দদায়ক ও চাপমুক্ত।

সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQ)

প্রশ্ন: নবজাতকের জন্য কোন ব্র্যান্ডের ডায়াপার ভালো? উত্তর: বাজারে বিভিন্ন ভালো ব্র্যান্ডের ডায়াপার পাওয়া যায় যেমন Molfix, Huggies, Pampers, NeoCare ইত্যাদি। আপনার শিশুর ত্বকে কোনটি স্যুট করে তা দেখার জন্য শুরুতে ছোট প্যাকেট কিনে পরীক্ষা করে নিতে পারেন।

প্রশ্ন: শিশুর জন্য প্রতিদিন গোসল করানো কি জরুরি? উত্তর: না, নবজাতককে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। সপ্তাহে ২-৩ দিনই যথেষ্ট। তবে প্রতিদিন স্পঞ্জ বাথ বা ভেজা নরম কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া ভালো।

প্রশ্ন: শিশুর জন্মের আগে কি সব পোশাক ধুয়ে ফেলা উচিত? উত্তর: হ্যাঁ, শিশুর ব্যবহারের জন্য কেনা সমস্ত নতুন কাপড়, কাঁথা ও তোয়ালে বেবি ডিটারজেন্ট বা মৃদু কোনো সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া উচিত। এতে কাপড়ে থাকা কেমিক্যাল বা ধুলোবালি দূর হয়ে যায়।

প্রশ্ন: ফিডিং বোতল কীভাবে জীবাণুমুক্ত করবো? উত্তর: ফিডিং বোতল ব্যবহারের পর গরম সাবান পানি ও ব্রাশ দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এছাড়া স্টেরিলাইজারও ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: শিশুর জন্য কোন ধরণের খেলনা নিরাপদ? উত্তর: নবজাতকের জন্য নরম, উজ্জ্বল রঙের এবং মুখে দিলেও ক্ষতি হবে না এমন খেলনা বেছে নিন। ছোট বা ধারালো অংশযুক্ত খেলনা একেবারেই করুন।

About Author
মনীষা মুখার্জী