আপনি কি জানেন, আজকের নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস একসময় নীল চাষের বিশাল প্রান্তর ছিল? যেখানে এখন হাজার হাজার বইপ্রেমী প্রতিদিন ভিড় জমায়, সেই স্থানটি ১৮৪৭ সালে ছিল ঢাকার ৩৭টি নীলকুঠির অন্যতম একটি এলাকা। কিন্তু কীভাবে একটি নীল চাষের জমি পরিণত হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বই বাজারে? এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে অনেক অজানা গল্প, যা আজও অধিকাংশ মানুষের অজানা।
নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস শুধু একটি বাণিজ্যিক বিকাশের গল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং জ্ঞান বিতরণের এক অনন্য দলিল। এই লেখায় আমরা উন্মোচন করব নীলক্ষেতের সেই সব গোপন অধ্যায়, যা কখনও মূলধারার আলোচনায় আসেনি।
নীল চাষের প্রান্তর থেকে বইয়ের সাম্রাজ্য: প্রারম্bhিক ইতিহাস
নীলক্ষেতের নামকরণের রহস্য
নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের নীল চাষ থেকে। ১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল, যার মধ্যে বর্তমান নীলক্ষেত এলাকার বিশাল প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ করা হতো। এই এলাকায় প্রচুর নীল উৎপাদন হওয়ায় স্থানীয়রা একে ‘নীলক্ষেত’ নামে ডাকতে শুরু করে – যেখানে ‘নীল’ মানে নীল রঙ এবং ‘ক্ষেত’ মানে চাষের জমি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেসময় এই এলাকায় কোনো স্থায়ী জনবসতি ছিল না। শুধুমাত্র নীল চাষ আর কুঠিবাড়ি নিয়েই গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে রূপান্তর
নীলক্ষেতের আসল পরিবর্তন শুরু হয় যখন এর আশেপাশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বুয়েট, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের বই-খাতার চাহিদা মেটাতেই প্রথমে গড়ে ওঠে ছোট ছোট বইয়ের দোকান।
১৯৬৬: নীলক্ষেত বই বাজারের প্রকৃত জন্ম
বালাকা সিনেমা হলের ফুটপাত থেকে শুরু
অনেকেই জানেন না যে, নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস অনুযায়ী ১৯৬৬ সাল থেকে প্রকৃতপক্ষে এই এলাকায় পাঠ্য বইয়ের বাজার শুরু হয়। প্রথমদিকে মাত্র চারজন তরুণ বই বিক্রেতা বালাকা সিনেমা হলের ফুটপাতে পুরোনো বই ও ম্যাগাজিন নিয়ে বসতো।
এই ছোট্ট শুরু থেকেই আজকের বিশাল নীলক্ষেত বই বাজারের যাত্রা। সত্তরের দশকে নীলক্ষেতে দুষ্প্রাপ্য সব বই পাওয়া যেত বলে একাধিক প্রবীণ জানিয়েছেন।
৯টি আলাদা মার্কেটের সমন্বয়
বর্তমানে নীলক্ষেত বই মার্কেট আসলে ৯টি আলাদা মার্কেটের সমন্বয়ে গঠিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ’ থেকে শুরু করে নীলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিশাল এলাকা। এখানে রয়েছে প্রায় ১,৩০০টি বইয়ের দোকান ও স্টেশনারি।
পাইরেসি বাণিজ্যের গোপন জগৎ: যা কেউ বলে না
তিনটি বড় ‘কপিবুক প্রকাশকের’ আধিপত্য
নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস-এর সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হলো পাইরেসি বই বাণিজ্য। শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, নীলক্ষেতে তিনটি বড় ‘কপিবুক প্রকাশক’ রয়েছে – তাজিন বইঘর, মলি প্রকাশনী এবং ওরিয়ান পাবলিকেশন্স।
প্রতি বছর অন্তত ৪ লাখ পাইরেটেড বই বিক্রি হয় এখানে। একটি দোকানেই রয়েছে প্রায় ৫০০টি বই, যার মধ্যে কিছুর ২০ হাজার কপি, আবার কোনোটির মাত্র ৫০০ কপি রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া রিভিউ ও হাইপের ভিত্তিতে বই নির্বাচন
আশ্চর্যজনকভাবে, এই পাইরেসি প্রকাশকরা ফেসবুক ও ইউটিউবের রিভিউ দেখে বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তাজিন বইঘরের মালিক মোহাম্মদ ফয়েজের মতে, “ইন্টারনেটে বই দেখে পাঠকরা আমাদের বলে দেন কোন বইগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে।”
আন্তর্জাতিক বই থেকে পিডিএফ কপির প্রক্রিয়া
একটি বই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রকাশের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এর পিডিএফ সংস্করণ ডার্ক ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। কপিবই বিক্রেতারা সেগুলো ডাউনলোড করে প্রিন্ট করেন। পাশের গাউসুল আজম মার্কেটে রয়েছে প্রিন্টিং ও বাঁধাইয়ের আরেক সাম্রাজ্য।
বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন
কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও পুনরুত্থান
২০২০ সালের কোভিড-১৯ লকডাউনে নীলক্ষেত বই বাজার মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যায়, বিক্রেতারা অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন। তবে ‘গ্রন্থমঙ্গল’ প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণ বইপ্রেমীরা প্রায় ৫০জন নীলক্ষেত বই বিক্রেতার কাছ থেকে ৩,৫০০টি বই কিনে অনলাইনে বিক্রি করে তাদের সাহায্য করেছিল।
ডিজিটাল যুগে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা
বর্তমানে নীলক্ষেতের অনেক দোকানি অনলাইনে বই বিক্রি শুরু করেছেন। ‘নীলক্ষেত বইয়ের বাজার’ ফেসবুক পেইজের মতো প্ল্যাটফর্মে এখন বই অর্ডার দেওয়া যায়।
অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তা সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরেই নীলক্ষেত বই মার্কেটগুলো রয়েছে মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে। এখানে কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। ফায়ার সার্ভিস সতর্ক করেছে যে, এই মার্কেটগুলো “তাতানো বারুদের স্তূপের” মতো বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।
সাহিত্য প্রেমীদের স্মৃতিতে নীলক্ষেত
পুরোনো দিনের গৌরব
একসময় নীলক্ষেতে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, আর্চিজ, টিনটিনের মতো জনপ্রিয় সিরিজের বই পাওয়া যেত। ক্লাসিক সাহিত্য থেকে শুরু করে চটি বই পর্যন্ত সব ধরনের বই এখানে পাওয়া যেত। একজন প্রবীণ বলেছেন, “নীলক্ষেতকে পবিত্র গ্রন্থতীর্থ বলতেও দ্বিধা নেই।”
বর্তমানে গাইড বইয়ের আধিপত্য
দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে নীলক্ষেতে প্রধানত বিসিএস, এমবিবিএস এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির গাইড বইয়ের আধিপত্য। উপন্যাস, কবিতা বা কমিকসের স্থান দখল করে নিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বই।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা
সরকারি উদ্যোগ ও আধুনিকীকরণ
সম্প্রতি রাজউক থেকে নীলক্ষেত বই মার্কেটে ছয়তলা বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এটি নীলক্ষেতের আধুনিকীকরণের একটি ইতিবাচক দিক।
শিক্ষা ব্যবস্থায় নীলক্ষেতের অবদান
একজন চিকিৎসক মন্তব্য করেছেন, “ক্ষমতা থাকলে নীলক্ষেত বই মার্কেটকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করতাম।” কারণ এই বাজার বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অমূল্য অবদান রেখেছে, বিশেষত উচ্চ শিক্ষার ব্যয়বহুল বইগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাগালে এনে দিয়ে।
নীলক্ষেত বই মার্কেট: পরিসংখ্যানে এক নজরে
বিষয় | তথ্য |
---|---|
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৯৬৬ সাল |
মোট দোকান | ১,৩০০+ |
বার্ষিক দর্শনার্থী | ১০ লক্ষ+ |
পাইরেটেড বই বিক্রি | ৪ লাখ+ বার্ষিক |
মার্কেট সংখ্যা | ৯টি আলাদা মার্কেট |
বৈচিত্র্যের সমাহার: কী নেই নীলক্ষেতে?
“যদি কোনো বই কোথাও খুঁজে না পাও, তবে নীলক্ষেতে একবার ঢুঁ মেরো” – এই কথাটি বইপ্রেমীদের মধ্যে প্রবাদতুল্য। একাডেমিক বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছাড়াও এখানে রয়েছে:
- সাহিত্য: দেশি-বিদেশি ক্লাসিক থেকে শুরু করে সমসাময়িক সব লেখকের বই।
- দুর্লভ ও অ্যান্টিক বই: অনেক সময় এখানে এমন কিছু পুরোনো ও দুর্লভ বইয়ের সন্ধান মেলে যা সংগ্রাহকদের জন্য অমূল্য।
- পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন: দেশ-বিদেশের পুরোনো এবং নতুন ম্যাগাজিনের এক বিশাল সম্ভার রয়েছে এখানে।
- গবেষণা ও রেফারেন্স বই: যেকোনো বিষয়ের উপর গবেষণা বা রেফারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় বই এখানে সহজেই পাওয়া যায়।
- চাকরির প্রস্তুতি: বিসিএস থেকে শুরু করে ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য সব ধরনের বইয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস এই নীলক্ষেত
- নীলক্ষেত বই মার্কেটের অজানা ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, একটি নীল চাষের জমি কীভাবে রূপান্তরিত হতে পারে জ্ঞানের মহাসাগরে। ১৮৪৭ সালের নীলকুঠি থেকে ২০২৫ সালের ডিজিটাল যুগের এই বিবর্তন শুধু একটি বাণিজ্যিক সাফল্যের গল্প নয়, বরং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও পাইরেসি ও আইনি জটিলতার মতো সমস্যা রয়েছে, তবুও লাখো শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম করার ক্ষেত্রে নীলক্ষেতের অবদান অনস্বীকার্য।