নেপালের ১৮ বছর বয়সী পর্বতারোহী নিমা রিনজি শেরপা বিশ্বের সর্বোচ্চ ১৪টি পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করে ইতিহাস গড়েছেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী ব্যক্তি হিসেবে এই অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
গত ৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নিমা তিব্বতের শিশাপাংমা পর্বতের (৮,০২৭ মিটার) শীর্ষে পৌঁছে তার অভিযান সম্পন্ন করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সকল ৮,০০০ মিটারের উপরের পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের লক্ষ্য পূরণ করেন।
নিমার এই অসাধারণ সাফল্য পর্বতারোহণ জগতে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে ২০২২ সালের আগস্টে মানাসলু পর্বত আরোহণের মাধ্যমে তার পর্বতারোহণ জীবন শুরু করেন। এরপর থেকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ ১৪টি পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ সম্পন্ন করেন।
১৮ বছর বয়সী নেপালি শেরপা নিমা রিনজি বিশ্বের সর্বোচ্চ ১৪টি পর্বতশৃঙ্গ জয় করে ইতিহাস গড়লেন!
নিমার এই অসামান্য কৃতিত্বের আগে ৩০ বছর বয়সী মিংমা গ্যাবু ‘ডেভিড’ শেরপা ২০১৯ সালে সবকটি আট হাজারি পর্বত আরোহণের রেকর্ড গড়েছিলেন। নিমা সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন।
নিমা একটি বিখ্যাত পর্বতারোহী পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা তাশি লাকপা শেরপা একজন বিখ্যাত পর্বতারোহী, যিনি ১৯ বছর বয়সে অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করে রেকর্ড গড়েছিলেন। নিমার কাকারাও বিখ্যাত পর্বতারোহী এবং তারা নেপালের সবচেয়ে বড় পর্বতারোহণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।
নিমার এই অসাধারণ সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমগ্র শেরপা সম্প্রদায়ের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। তিনি তার এই সাফল্যকে “#SherpaPower” প্রকল্পের প্রতি উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেন, “এই শীর্ষ আরোহণ শুধু আমার ব্যক্তিগত যাত্রার পরিণতি নয়, এটি প্রতিটি শেরপার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন যারা আমাদের জন্য নির্ধারিত প্রথাগত সীমানা অতিক্রম করার স্বপ্ন দেখেছেন। পর্বতারোহণ কেবল শ্রম নয়, এটি আমাদের শক্তি, সহনশীলতা এবং আবেগের প্রমাণ।”
নিমা আরও বলেন, “#SherpaPower এর মাধ্যমে আমি তরুণ প্রজন্মের শেরপাদের দেখাতে চাই যে তারা কেবল সহায়ক আরোহীর গতানুগতিক ধারণা অতিক্রম করে নিজেদেরকে শীর্ষ মানের ক্রীড়াবিদ, অ্যাডভেঞ্চারার এবং সৃষ্টিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আমরা শুধু গাইড নই; আমরা পথপ্রদর্শক। এটি প্রতিটি শেরপার প্রতি আহ্বান যাতে তারা আমাদের কাজের মর্যাদা, আমাদের ঐতিহ্যের শক্তি এবং আমাদের ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনা দেখতে পায়।”
নিমার এই অর্জন শেরপা সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় প্রেরণা। ঐতিহ্যগতভাবে শেরপারা বিদেশী আরোহীদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এসেছেন। তারা সরঞ্জাম বহন করে, দড়ি টানে এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পথ দেখায়। কিন্তু প্রায়শই তাদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় না। নিমার এই সাফল্য শেরপাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।
নিমার এই অসামান্য কৃতিত্বের পিছনে রয়েছে তার কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্প। তিনি মাত্র দুই বছর দশ দিনের মধ্যে সমস্ত ১৪টি আট হাজারি পর্বত আরোহণ সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালে একই বছরে তিনি ৯টি আট হাজারি পর্বত আরোহণ করেন, যা নিজেই একটি অসাধারণ কৃতিত্ব।
নিমার এই সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমগ্র নেপালের জন্য গর্বের বিষয়। নেপাল পর্বতারোহণ সংস্থার সভাপতি নিমা নুরু শেরপা বলেন, “এটি আমাদের দেশের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত। নিমা সব ধরনের গতানুগতিক ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং তার সাফল্য একটি বার্তা দিয়েছে যে দৃঢ় সংকল্প থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।”
নিমার এই অর্জন আন্তর্জাতিক পর্বতারোহণ মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্বতারোহীরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ১৪ পিকস এক্সপেডিশন কোম্পানি তাদের অভিনন্দন বার্তায় বলেছে, “মাত্র ১৮ বছর বয়সে নিমার এই যাত্রা তার অসাধারণ শক্তি, দৃঢ়তা এবং শেরপা সম্প্রদায়ের মনোবলের প্রতিফলন।”
নিমার এই সাফল্য শুধু পর্বতারোহণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তার বার্তায় সমগ্র মানবজাতির প্রতি একটি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মানবতার প্রতি: এই আরোহণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিক যে আমরা একসাথে, ঐক্যবদ্ধভাবে যে শীর্ষে পৌঁছাতে পারি তা যে কোনো ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে অনেক বেশি। একজন কিশোর হিসেবে, সীমানা, যুদ্ধ, বর্ণবাদ এবং অন্যান্য দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট বিভাজন দেখে, আমি সকল মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতির আহ্বান জানাই। এই বিশাল পৃথিবীতে আমরা কেবল এক মানব জাতি। কোনো শীর্ষ, কোনো সীমানা, কোনো দ্বন্দ্ব একে অপরকে বোঝার এবং সমর্থন করার মাধ্যমে আমরা যে শান্তি ও ঐক্য অর্জন করতে পারি তার চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়।”
নিমা শুধু পর্বতারোহণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। তিনি প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, “পর্বত আমাদের সংজ্ঞায়িত করে না; আমরাই পর্বতকে সংজ্ঞায়িত করি। আমরা এর অভিভাবক, একইভাবে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি তা সেখানে বসবাসকারী মানুষদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হওয়া উচিত! আসুন আমরা সবাই একত্রিত হই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে যাতে একটি টেকসই ও অ্যাডভেঞ্চার-পূর্ণ জীবন যাপন করতে পারি!”
নিমার এই অসাধারণ কৃতিত্ব শুধু পর্বতারোহণের ইতিহাসে নয়, সমগ্র ক্রীড়াজগতে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। তার বয়স ও অদম্য সাহস প্রমাণ করেছে যে বয়স কখনোই প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং দৃঢ় সংকল্প ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। নিমার এই সাফল্য আগামী দিনে আরও অনেক তরুণ পর্বতারোহীকে অনুপ্রাণিত করবে বলে আশা করা যায়।