নোবেল পুরস্কার ২০২৫: মানবজাতির কল্যাণে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য বিজয়ীদের সম্পূর্ণ তালিকা ও বিশ্লেষণ

বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার, নোবেল পুরস্কার ২০২৫-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানবজাতির জ্ঞান ও অগ্রগতির ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। সুইডেনের স্টকহোম এবং নরওয়ের অসলো থেকে নোবেল কমিটি…

Laboni Das

 

বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার, নোবেল পুরস্কার ২০২৫-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানবজাতির জ্ঞান ও অগ্রগতির ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। সুইডেনের স্টকহোম এবং নরওয়ের অসলো থেকে নোবেল কমিটি চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদানের জন্য বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে। এই পুরস্কার শুধু ব্যক্তিগত প্রতিভার স্বীকৃতি নয়, বরং মানবকল্যাণে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তির অন্বেষণকে সম্মান জানানো। নোবেল পুরস্কারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বিজয়ীরা একটি স্বর্ণপদক, একটি ডিপ্লোমা এবং ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার (প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অর্থ পুরস্কার লাভ করবেন, যা তাঁদের ভবিষ্যৎ গবেষণা ও কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

এবারের বিজয়ীদের তালিকায় যেমন উঠে এসেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার রহস্য উন্মোচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, তেমনই স্থান পেয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল জগতকে উন্মোচনকারী আবিষ্কার। প্রতিটি পুরস্কারের পেছনে রয়েছে বহু বছরের সাধনা, অকল্পনীয় পরিশ্রম এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয়। এই প্রবন্ধে আমরা ২০২৫ সালের নোবেল বিজয়ীদের নাম, তাঁদের যুগান্তকারী অবদান এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

নোবেল পুরস্কারের যাত্রা: আলফ্রেড নোবেলের উইল থেকে আজকের সম্মাননা

প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এক উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। কিন্তু এই পুরস্কারের পেছনের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। ডিনামাইট আবিষ্কারক এবং সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া উইল থেকেই এই পুরস্কারের জন্ম। ১৮৯৫ সালে করা তাঁর উইলে, নোবেল তাঁর বিশাল সম্পত্তির প্রায় ৯৪ শতাংশ মানবকল্যাণে যুগান্তকারী অবদানের জন্য পুরস্কার হিসেবে প্রদানের নির্দেশ দেন।

তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে যাঁরা মানবজাতির জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর কাজ করবেন, তাঁদের এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে, ১৯৬৮ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, Sveriges Riksbank, আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রবর্তন করে, যা নোবেল পুরস্কারের মতোই সম্মানজনক। নোবেলের এই উইল অনুযায়ী, রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও অর্থনীতির বিজয়ী নির্বাচন করে। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট চিকিৎসাবিজ্ঞানে এবং সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে বিজয়ী নির্বাচন করে। অন্যদিকে, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কারের বিজয়ী নির্বাচন করে, যা আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

কীভাবে বিজয়ী নির্বাচন করা হয়?

নোবেল পুরস্কারের বিজয়ী নির্বাচনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠোর এবং গোপনীয়। প্রতি বছর सप्टेंबर মাসে নোবেল কমিটি বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার নির্বাচিত ব্যক্তি, যেমন—বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, পূর্ববর্তী নোবেল বিজয়ী এবং সংসদীয় সমিতির সদস্যদের কাছে মনোনয়নপত্র পাঠায়। মনোনয়নের এই প্রক্রিয়াটি পরের বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে শেষ হয়। কোনো ব্যক্তি নিজেকে মনোনয়ন দিতে পারেন না। এরপর নোবেল কমিটিগুলো সেই মনোনয়নপত্রগুলো পর্যালোচনা করে এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে। চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচনের আগে প্রতিটি শাখায় गहन পর্যালোচনা ও ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয় এবং বিজয়ীর নাম ঘোষণার আগ পর্যন্ত সবকিছু অত্যন্ত গোপন রাখা হয়। এমনকি মনোনীতদের নামও পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য প্রকাশ করা হয় না, যা এই পুরস্কারের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতাকে অক্ষুণ্ণ রাখে।

নোবেল পুরস্কার ২০২৫: বিজয়ীদের সম্পূর্ণ তালিকা

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত প্রতীক্ষিত একটি ঘটনা। ২০২৫ সালের বিজয়ীদের নাম এবং তাঁদের অবদান নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

বিভাগ বিজয়ীর নাম অবদান
চিকিৎসাবিজ্ঞান মেরি ই. ব্রুনকো, ফ্রেড র‍্যামসডেল, এবং শিমন সাকাগুচি পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স সংক্রান্ত আবিষ্কারের জন্য।
পদার্থবিজ্ঞান জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ. ডেভোরেট, এবং জন এম. মার্টিনিস একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং শক্তির কোয়ান্টাইজেশন আবিষ্কারের জন্য।
রসায়ন ঘোষণা করা হবে (৮ অক্টোবর, ২০২৫) প্রতীক্ষিত
সাহিত্য ঘোষণা করা হবে (৯ অক্টোবর, ২০২৫) প্রতীক্ষিত
শান্তি ঘোষণা করা হবে (১০ অক্টোবর, ২০২৫) প্রতীক্ষিত
অর্থনীতি ঘোষণা করা হবে (১৩ অক্টোবর, ২০২৫) প্রতীক্ষিত

চিকিৎসাবিজ্ঞান: দেহের নিজস্ব “শান্তিরক্ষক” কোষের রহস্য উন্মোচন

২০২৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিন বিজ্ঞানী: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরি ই. ব্রুনকো (Mary E. Brunkow)ফ্রেড র‍্যামসডেল (Fred Ramsdell) এবং জাপানের শিমন সাকাগুচি (Shimon Sakaguchi)। তাঁদের যুগান্তকারী গবেষণা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (Immune System) একটি জটিল দিক “পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স” (Peripheral Immune Tolerance) এর রহস্য উন্মোচন করেছে।

কেন এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ?

মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত ক্ষতিকারক জীবাণু, যেমন—ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা ভুল করে দেহের নিজস্ব কোষকেই আক্রমণ করে বসে, যার ফলে অটোইমিউন রোগ (Autoimmune diseases) যেমন—টাইপ-১ ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। এই তিন বিজ্ঞানীর গবেষণা ব্যাখ্যা করে, কীভাবে আমাদের শরীর তার নিজের কোষ এবং বহিরাগত শত্রুর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে এবং ভুল আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে।

তাঁরা “টি-রেগুলেটরি কোষ” (T-regulatory cells) নামক এক বিশেষ ধরণের কোষ আবিষ্কার করেন, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় “শান্তিরক্ষক” হিসেবে কাজ করে। এই কোষগুলো ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত রাখে এবং নিশ্চিত করে যেন এটি দেহের সুস্থ কোষগুলোকে আক্রমণ না করে। আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আবিষ্কার অটোইমিউন রোগের চিকিৎসা এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনের (Organ transplantation) ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বর্তমানে এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সার এবং বিভিন্ন অটোইমিউন রোগের নতুন থেরাপি তৈরির কাজ চলছে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

পদার্থবিজ্ঞান: কোয়ান্টাম জগতের বিস্ময়কর আচরণ উন্মোচন

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে এক অবিশ্বাস্য সাফল্যের জন্য ২০২৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী: জন ক্লার্ক (John Clarke), মিশেল এইচ. ডেভোরেট (Michel H. Devoret), এবং জন এম. মার্টিনিস (John M. Martinis)। তাঁদের গবেষণা “ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে শক্তির কোয়ান্টাইজেশন” আবিষ্কারের জন্য, যা কোয়ান্টাম জগতকে পারমাণবিক স্তরের বাইরেও পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ করে দিয়েছে।

গবেষণার তাৎপর্য কী?

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মগুলো সাধারণত পরমাণু এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র কণার জগতে প্রযোজ্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু এই তিন বিজ্ঞানী তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো একটি বড়, মানুষের তৈরি বৈদ্যুতিক সার্কিটেও ঘটতে পারে। তাঁরা সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ সার্কিট, যা “জোসেফসন জংশন” নামে পরিচিত, ব্যবহার করে এই পরীক্ষা চালান।

দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, তাঁদের আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে কোয়ান্টাম টানেলিং (যেখানে একটি কণা কোনো বাধা ভেদ করে চলে যেতে পারে) এবং শক্তির কোয়ান্টাইজেশন (যেখানে শক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণে বিভক্ত থাকে) শুধু পারমাণবিক জগতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সাফল্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির মতো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে। আজকের দিনের আধুনিক ট্রানজিস্টর এবং মাইক্রোচিপ তৈরিতেও তাঁদের গবেষণার পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। তাঁদের এই কাজ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছে।

রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতি: প্রতীক্ষিত ঘোষণা

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত (৭ অক্টোবর, ২০২৫) রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এখনও আসেনি। নোবেল কমিটির  সময়সূচী অনুযায়ী, এই পুরস্কারগুলোর ঘোষণা নিম্নলিখিত তারিখে করা হবে:

  • রসায়ন: ৮ অক্টোবর, বুধবার
  • সাহিত্য: ৯ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার
  • শান্তি: ১০ অক্টোবর, শুক্রবার
  • অর্থনীতি: ১৩ অক্টোবর, সোমবার

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী, লেখক, শান্তিবাদী এবং অর্থনীতিবিদরা অধীর আগ্রহে এই ঘোষণাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রতিটি শাখাতেই সম্ভাব্য বিজয়ীদের নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। রসায়নে নতুন অনুঘটক বা বায়োমোলিকিউলার প্রক্রিয়া, সাহিত্যে মানবিকতার গভীর উন্মোচন, শান্তিতে বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে অবদান এবং অর্থনীতিতে বৈষম্য বা বাজার ব্যবস্থার নতুন কোনো তত্ত্ব—যেকোনো কিছুই এবছর সম্মানিত হতে পারে।

নোবেল পুরস্কারের আর্থিক ও সামাজিক মূল্য

নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্য প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও এর সম্মান ও সামাজিক মূল্য অপরিসীম। নোবেল বিজয়ীরা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন এবং তাঁদের গবেষণা বা কাজের ক্ষেত্র আরও বেশি গুরুত্ব ও সমর্থন পায়। এই পুরস্কার বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করে এবং একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখায়। আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া এই উত্তরাধিকার আজও মানবজাতির অগ্রযাত্রায় এক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে।

About Author
Laboni Das

এখানে লাবনী দাশের জন্য একটি সম্ভাব্য Author Bio প্রস্তাব করছি: লাবনী দাশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান লেখিকা এবং সাংবাদিক, যিনি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমসাময়িক বিষয়ে লিখে থাকেন। তাঁর লেখায় সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ফুটে ওঠে। লাবনী নিয়মিত এই ওয়েবসাইটে প্রবন্ধ, গল্প ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।