nose picking alzheimer risk: অনেকেই মনে করেন নাক খোঁটা একটি সাধারণ অভ্যাস মাত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। নাক খোঁটার অভ্যাস শুধু স্বাস্থ্যগতভাবে অস্বাস্থ্যকরই নয়, বরং এটি মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে, এই আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ অভ্যাসটি অ্যালঝাইমার রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। আজকের এই নিবন্ধে আমরা জানবো কীভাবে এই সাধারণ অভ্যাসটি আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে এবং কী করে এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
নাক খোঁটার অভ্যাস কতটা সাধারণ?
প্রায় প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় নাক খুঁটে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ নিয়মিত বা মাঝেমধ্যে নাক খোঁটে। অনেকে এটিকে একটি নিরীহ অভ্যাস বলে মনে করলেও, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি ‘রাইনোটিলেক্সোমেনিয়া’ নামক একটি আচরণগত সমস্যা।
নাক খোঁটার অভ্যাস সাধারণত শৈশবে শুরু হয় এবং অনেকের ক্ষেত্রে সারাজীবন চলতে থাকে। স্ট্রেস, উৎকণ্ঠা, বিরক্তি বা একঘেয়েমির কারণে মানুষ অনেক সময় অজান্তেই নাক খুঁটতে শুরু করে। কিন্তু এই সাধারণ অভ্যাসটিই যে মস্তিষ্কের জন্য এতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা অনেকেই জানেন না।
নাকের বড়ো চুল (Nose Long Hair): শাস্ত্রে কী বলছে, বিজ্ঞানে কী ব্যাখ্যা?
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘন ঘন নাক খোঁটার ফলে নাকের ভেতরের টিস্যুতে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এই ক্ষতস্থান দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সহজেই মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল, কোরিনেব্যাকটেরিয়াম জেরোসিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া নাকের পথ দিয়ে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং নিউরোইনফ্লেমেশনের কারণ হয়। দীর্ঘমেয়াদী নিউরোইনফ্লেমেশন অ্যালঝাইমার রোগের একটি প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, নাক খোঁটার অভ্যাস যত বেশি হবে, মস্তিষ্কে ক্ষতিকর প্রোটিন জমার সম্ভাবনা তত বেশি। এই প্রোটিন জমাই অ্যালঝাইমার রোগের মূল কারণ।
কীভাবে নাক থেকে মস্তিষ্কে পৌঁছায় ব্যাকটেরিয়া?
মানুষের নাক এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি সরাসরি সংযোগ রয়েছে যা অলফ্যাক্টরি নার্ভ বা গন্ধ স্নায়ু নামে পরিচিত। এই পথটি সাধারণত গন্ধের তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই একই পথ দিয়ে ক্ষতিকর জীবাণুও মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে।
যখন আমরা নাক খুঁটি, তখন নাকের ভেতরের সূক্ষ্ম টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতিগ্রস্ত স্থান দিয়ে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য প্যাথোজেন সহজেই রক্তপ্রবাহে মিশে যায় এবং পরবর্তীতে মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
আরও ভয়াবহ বিষয় হল, আমাদের হাতে অসংখ্য জীবাণু থাকে। যখন আমরা নাক খুঁটি, তখন এই সব জীবাণু নাকের ভেতরে চলে যায়। পরে এগুলোই মস্তিষ্কের পথ খুঁজে নেয়।
অ্যালঝাইমার রোগ কী এবং কেন ভয়ঙ্কর?
অ্যালঝাইমার রোগ হল একটি প্রগতিশীল নিউরোডিজেনেরেটিভ রোগ যা মূলত বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। এই রোগে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে, ফলে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা এবং আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, যার মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশই অ্যালঝাইমার রোগে ভুগছেন। ভারতে এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নাক খোঁটার অভ্যাস থেকে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, তা মস্তিষ্কে বিটা-অ্যামাইলয়েড এবং টাউ প্রোটিনের জমা বাড়িয়ে দেয়। এই দুটি প্রোটিনই অ্যালঝাইমার রোগের প্রধান লক্ষণ।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব
ভারতীয় সমাজে নাক খোঁটার বিষয়টি নিয়ে খুব একটা সচেতনতা নেই। অনেকে এটিকে একটি স্বাভাবিক অভ্যাস বলে মনে করেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বায়ু প্রদূষণ এবং ধুলাবালির কারণে নাকে জ্বালাপোড়া হওয়ায় মানুষ আরও বেশি নাক খুঁটছেন।
ভারতে বায়ু প্রদূষণের মাত্রা বিশ্বের গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতার মতো মেগাসিটিতে বায়ুর গুণমান ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। এই প্রদূষিত বাতাসে নাকে অস্বস্তি হওয়ায় মানুষ আরও বেশি নাক খুঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এই অভ্যাসটি বেশি দেখা যায়। অভিভাবকরা অনেক সময় এই বিষয়ে গুরুত্ব দেন না, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি
নাক খোঁটার অভ্যাস শুধুমাত্র অ্যালঝাইমারের ঝুঁকিই বাড়ায় না, আরও অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে:
সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি: নাক খোঁটার ফলে নাকের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা দিয়ে সহজেই ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।
নাক থেকে রক্তক্ষরণ: ঘন ঘন নাক খোঁটার ফলে নাকের ভেতরের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্তপাত হতে পারে।
সেপটাল পারফরেশন: অতিরিক্ত নাক খোঁটার ফলে নাকের মধ্যবর্তী হাড়ে ছিদ্র হয়ে যেতে পারে।
সামাজিক বিব্রতকর অবস্থা: প্রকাশ্যে নাক খোঁটা সামাজিকভাবে অশোভনীয় আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে মুক্তির উপায়
নাক খোঁটার অভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তবে এর জন্য ধৈর্য এবং সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
হাত পরিষ্কার রাখুন: নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার রাখুন। হাত পরিষ্কার থাকলে নাক খোঁটার প্রবণতা কমে যায়।
নাকের যত্ন নিন: নাক শুষ্ক হলে অনেকে নাক খুঁটতে চান। নাকে স্যালাইন ড্রপ বা নাক ভেজানোর জন্য হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
বিকল্প কাজে মনোযোগ দিন: যখন নাক খোঁটার ইচ্ছা হয়, তখন হাত দিয়ে অন্য কোনো কাজ করুন। ফিজেট স্পিনার বা স্ট্রেস বল ব্যবহার করতে পারেন।
নখ ছোট রাখুন: নখ লম্বা থাকলে নাক খোঁটার সুবিধা বেশি হয়। তাই নিয়মিত নখ কেটে ছোট রাখুন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন: স্ট্রেস এবং উৎকণ্ঠা কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করুন।
পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা
নাক খোঁটার অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে পরিবার এবং সমাজের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
অভিভাবকরা শিশুদের ধমক না দিয়ে বরং ধৈর্য সহকারে বোঝাতে পারেন যে এই অভ্যাসটি কেন ক্ষতিকর। শিশুদের হাতে খেলনা দিয়ে রাখা, নিয়মিত নাক পরিষ্কার করে দেওয়া এবং প্রশংসার মাধ্যমে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
স্কুল এবং কমিউনিটি লেভেলে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য শিক্ষার অংশ হিসেবে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
নাক খোঁটার অভ্যাস যে শুধুমাত্র একটি খারাপ অভ্যাস নয়, বরং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে, তা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অ্যালঝাইমারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষা করতে হলে আজই এই ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ করা জরুরি। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্য সচেতনতাই সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি। আপনার মতামত এবং অভিজ্ঞতা কমেন্টে শেয়ার করুন, এবং এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি অন্যদের সাথেও ভাগ করে নিন।