পাকিস্তানে গত শনিবার রাতে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় খুন হয়েছেন লশকর-ই-তৈবার শীর্ষ জঙ্গি নেতা আবু কাতাল। তিনি ছিলেন ২৬/১১ মুম্বই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হাফিজ সইদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জম্মু-কাশ্মীরে একাধিক সন্ত্রাসবাদী হামলার মূলচক্রী হিসেবে পরিচিত এই জঙ্গি পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের ঝিলম জেলায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হন। ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা এই জঙ্গির মৃত্যুতে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কে বড় ধাক্কা লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে কারা এই হামলার পিছনে রয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার রাতে, যখন আবু কাতাল গাড়িতে করে ঝিলমের ডিনা এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সূত্রের খবর, তিনি তার গাড়ির চালকের সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবু কাতাল ও তার চালকের মৃত্যু হয়। পাকিস্তান পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে, কিন্তু এখনও কোনো স্পষ্ট সূত্র মেলেনি। কিছু সূত্রের দাবি, এটি হয়তো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল হতে পারে, আবার কেউ কেউ মনে করছেন এর পিছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। তবে এসব দাবি এখনও প্রমাণিত হয়নি। পাকিস্তান সেনার কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও এমন হামলা অনেক প্রশ্ন তুলেছে।
আবু কাতালের পরিচয় শুধু হাফিজ সইদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন লশকর-ই-তৈবার প্রধান অপারেশনাল কমান্ডার। জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ সালে তিনি ভারতে অনুপ্রবেশ করেন। এরপর থেকে পুঞ্চ, রাজৌরি এবং রিয়াসি জেলায় একাধিক হামলার পরিকল্পনা করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি রাজৌরির ঢাংরি গ্রামে জঙ্গি হামলায় দুই শিশুসহ সাতজন নিহত হন। এই হামলার চার্জশিটে তার নাম উঠে এসেছে। এছাড়া, ২০২৪ সালের ৯ জুন রিয়াসি জেলায় শিব খোরি মন্দির থেকে ফেরা তীর্থযাত্রীদের বাসে হামলার নেতৃত্বও তিনিই দিয়েছিলেন, যেখানে ১০ জন নিহত হন।
জঙ্গি কার্যকলাপের পাশাপাশি আবু কাতাল পাক অধিকৃত কাশ্মীরের খুরেটা শিবিরের কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ভারতে অনুপ্রবেশে সহায়তা করা ছিল তার মূল কাজ। শুধু হামলার পরিকল্পনাই নয়, ড্রোনের মাধ্যমে অস্ত্র পাচারেও তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, হাফিজ সইদের সরাসরি নির্দেশে তিনি কাশ্মীরে নাশকতা চালাতেন। এনআইএ-এর চার্জশিটে তার সঙ্গে আরও দুই পাকিস্তানি জঙ্গি সাজিদ জাট এবং কাশিমের নামও উল্লেখ রয়েছে। এই তিনজন মিলে নিরাপত্তা বাহিনী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর বেশ কয়েকটি হামলা সংঘটিত করেছিলেন।
এদিকে, আবু কাতালের মৃত্যুর পর হাফিজ সইদের অবস্থা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে। কিছু সূত্র দাবি করেছে, হামলার সময় তিনিও গাড়িতে ছিলেন এবং গুলিতে তারও মৃত্যু হয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র জানাচ্ছে, হাফিজ গুরুতর আহত হয়ে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এই তথ্য এখনও নিশ্চিত হয়নি। উল্লেখ্য, হাফিজ সইদ দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকলেও সেখানকার সরকার তার উপস্থিতি অস্বীকার করে এসেছে। তার মাথার দাম প্রায় এক কোটি ডলার ঘোষণা করা হয়েছে এবং তিনি এনআইএ ও ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন।
সাধারণভাবে, আবু কাতালের মৃত্যুকে লশকর-ই-তৈবার জন্য বড় ক্ষতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার হাতে পরিচালিত হামলাগুলো শুধু ভারতের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি ছিল না, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ককেও শক্তিশালী করেছিল। এই ঘটনার পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। পাকিস্তানে এমন একজন শীর্ষ জঙ্গির খুনের পিছনে কী কারণ রয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, এর পিছনের রহস্য উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের গতিপ্রকৃতির ওপর নতুন আলোকপাত করেছে। আবু কাতালের মতো একজন কুখ্যাত জঙ্গির অপসারণ নিঃসন্দেহে কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে হাফিজ সইদের মতো বড় মাথা এখনও সক্রিয় থাকলে সন্ত্রাসবাদের হুমকি পুরোপুরি দূর হবে না। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।