One country one vote: ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে মোদী সরকার। “এক দেশ এক ভোট” (One Nation One Election) প্রস্তাবটি ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে। এর মাধ্যমে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। তবে এর সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
“এক দেশ এক ভোট” প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হল লোকসভা ও সমস্ত রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত করা। বর্তমানে লোকসভা ও বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন আলাদা আলাদা সময়ে হয়। এই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর অন্তর একসঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন হবে। তবে পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও উপনির্বাচনগুলি এর আওতায় আসবে না।
আর্থিক সাশ্রয়: একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোরও প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৬০,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। একসঙ্গে নির্বাচন হলে এই খরচ অনেকটাই কমবে।
প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি: বারবার নির্বাচনের জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েন করতে হয়। একসঙ্গে নির্বাচন হলে এই সমস্যা দূর হবে। ফলে প্রশাসনিক কাজকর্ম আরও দক্ষতার সঙ্গে চালানো যাবে।
উন্নয়ন কাজে গতি: ঘন ঘন নির্বাচনের কারণে আদর্শ আচরণবিধি জারি হয়। ফলে উন্নয়নমূলক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। একসঙ্গে নির্বাচন হলে এই সমস্যা থাকবে না।
ভোটের হার বৃদ্ধি: বারবার ভোট দিতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একসঙ্গে নির্বাচন হলে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাংবিধানিক জটিলতা: এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করতে হবে। বিশেষ করে ৮৩, ৮৫, ১৭২, ১৭৪ ও ৩৫৬ নম্বর ধারা। এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
আঞ্চলিক ইস্যু হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা: একসঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন হলে জাতীয় ইস্যুগুলো বেশি গুরুত্ব পেতে পারে। ফলে আঞ্চলিক সমস্যাগুলো অবহেলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষতি: জাতীয় দলগুলোর তুলনায় আঞ্চলিক দলগুলো অর্থ ও সংগঠনের দিক থেকে দুর্বল। একসঙ্গে নির্বাচন হলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
ইভিএম সংকট: একসঙ্গে নির্বাচন করাতে গেলে বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ ইভিএম লাগবে। এর জন্য প্রতি ১৫ বছরে ১০,০০০ কোটি টাকা খরচ হবে।
মধ্যবর্তী সরকার পতনের সমস্যা: কোনো রাজ্যে বা কেন্দ্রে মেয়াদের মাঝপথে সরকার পড়ে গেলে সেখানে আবার নির্বাচন করাতে হবে। এতে এক দেশ এক ভোটের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই প্রস্তাবের প্রধান সমর্থক। তাঁর মতে, এর ফলে দেশের অর্থ ও সম্পদের অপচয় রোধ হবে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।অন্যদিকে, কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলো এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এটি গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটিকে “অসাংবিধানিক ও যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এক দেশ এক ভোটের ধারণাটি নতুন নয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হত। ১৯৬৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন কারণে এই ব্যবস্থা ভেঙে যায়।১৯৮৩ সালে নির্বাচন কমিশন প্রথম একসঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। ১৯৯৯ সালে আইন কমিশনও এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়। ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
‘এক দেশ এক ভোট’: মোদী সরকারের বিতর্কিত প্রস্তাব পাশ, কী হতে চলেছে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থায়?
এক দেশ এক ভোট প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধন ও সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। এছাড়া অন্তত অর্ধেক রাজ্যের অনুমোদনও লাগবে।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে বিস্তৃত আলোচনা ও সর্বদলীয় সম্মতি প্রয়োজন। একটি পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা যাচাই করা যেতে পারে। পাশাপাশি ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার।
সামগ্রিকভাবে, এক দেশ এক ভোট প্রস্তাবটি ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর সুফল পেতে হলে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব কিনা, সেটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
মন্তব্য করুন