ভারত সরকার সম্প্রতি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশের অনলাইন বেটিং ও গ্যাম্বলিং জগতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১২৯৮টি অনলাইন বেটিং ও গ্যাম্বলিং ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো দেশের শিশু-কিশোরদের এই আসক্তি থেকে রক্ষা করা এবং সাইবার অপরাধ কমানো। জানা গেছে, ভারতে অনলাইন গেমিংয়ের বাজার বর্তমানে ৩১ হাজার কোটি টাকার। এই বিশাল ব্যবসার একটি বড় অংশই বেটিং ও জুয়ার মাধ্যমে চলছিল, যা এখন সরকারের কঠোর হস্তে বন্ধের পথে।
গত কয়েক বছরে ভারতে অনলাইন গেমিংয়ের জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বেটিং ও জুয়ার প্রবণতাও। কেন্দ্রীয় তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব লোকসভায় জানিয়েছেন, ২০২৪ সালেই ১০৯৭টি ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। এই ওয়েবসাইটগুলো শুধু গ্যাম্বলিংয়ে প্ররোচিত করত না, বরং সাইবার অপরাধের একটি বড় মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছিল। তথ্য প্রযুক্তি আইনের আওতায় এই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালে মহাদেব গেমিং অ্যাপ কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সরকার এই বিষয়ে আরও সতর্ক হয়ে ওঠে। ওই অ্যাপের মাধ্যমে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, পোকারের মতো খেলায় জুয়া চলত, এমনকি দিনে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের তথ্যও উঠে এসেছিল।
বিষয়টির গভীরতা বোঝার জন্য আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। গেম ডেভেলপারস কনফারেন্সের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের অনলাইন গেমিং বাজার ২০২৯ সালের মধ্যে ৭৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বৃদ্ধির পেছনে শিশু-কিশোরদের বড় ভূমিকা রয়েছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ শিশু-কিশোর অনলাইন গেমিংয়ের প্রতি আসক্ত। এই আসক্তি শুধু সময় নষ্টই করছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপ তাই শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য রয়েছে। ভারতে অনলাইন বেটিং ও গ্যাম্বলিং আইনত নিষিদ্ধ হলেও, অনেক ওয়েবসাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হতো। এগুলো সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার করা হতো এবং লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করত। উদাহরণস্বরূপ, মহাদেব অ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো মাধ্যমে বিজ্ঞাপন চালাত। এছাড়া, এই ওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে টাকা লেনদেনের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহারও বেড়ে গিয়েছিল, যা ট্র্যাক করা কঠিন। সরকার এই সব দিক বিবেচনা করেই কঠোর হস্তে দমনের পথ বেছে নিয়েছে।
সাধারণ মানুষের জন্য এই সিদ্ধান্তের অর্থ অনেক। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এতে গেমিং শিল্পের ক্ষতি হবে কি না। কিন্তু সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট—তারা শুধু বেআইনি বেটিং ও জুয়ার বিরুদ্ধে। বৈধ গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। তবে, এই পদক্ষেপের ফলে অনেক তরুণ-তরুণীর জীবন বদলে যেতে পারে। যারা অজান্তে বা লোভে পড়ে এই জুয়ার জগতে ঢুকে পড়ছিল, তারা এখন সচেতন হওয়ার সুযোগ পাবে। অভিভাবকদের জন্যও এটি স্বস্তির খবর, কারণ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমবে।
এই ঘটনার আরেকটি দিক হলো সাইবার নিরাপত্তা। অনলাইন বেটিং সাইটগুলো শুধু জুয়ার মাধ্যমই নয়, বরং ডেটা চুরি, ফিশিংয়ের মতো অপরাধেরও হাতিয়ার হয়ে উঠছিল। অনেক সময় ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে দেওয়া হতো। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা তাই সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধেও একটি বড় পদক্ষেপ। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার এই বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারি চালাবে এবং প্রয়োজনে নতুন আইনও আনা হতে পারে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ৩১ হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাবে সাধারণ মানুষ। তবে, এই নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের উপর। সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।