জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরের কাছে লিদওয়াস এলাকায় সোমবার (২৮ জুলাই) ‘অপারেশন মহাদেব’ নামে একটি যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এবং সিআরপিএফের এই সফল অভিযানে নিহত জঙ্গিদের মধ্যে পহেলগাম হামলার সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহ রয়েছে। গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে সংঘটিত নৃশংস হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক ও একজন নেপালি নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিনার কর্পস সামাজিক মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে যে দাচিগাম জঙ্গলের লিদওয়াস এলাকায় পরিচালিত এই অভিযানে তিন জঙ্গির সাথে সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে সুলেমান, ইয়াসির ও হামজা নামের তিন জঙ্গি রয়েছে, যাদের পহেলগাম হামলার সাথে সংযোগ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও মুসা নামের আরেক জঙ্গির সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ১৫ দিন ধরে এই অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সোমবার সকালে যখন অভিযান শুরু হয়, তখন নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে নিশ্চিত তথ্য ছিল যে ৩ থেকে ৪ জন জঙ্গি ঘন জঙ্গলের গভীরে গোপন ঘাঁটিতে লুকিয়ে রয়েছে। ড্রোন, থার্মাল ইমেজিং এবং হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের সমন্বয়ে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
অভিযানটি সকাল ১১টা নাগাদ শুরু হয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে গুলির লড়াই চলে। দাচিগাম বনাঞ্চলের উপরের অংশে বিশেষ নজর দিয়ে পরিচালিত এই যৌথ অভিযানে প্রথমে দুই জঙ্গিকে খতম করা হয়, পরে তৃতীয় জঙ্গিকে নিকেশ করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে যে নিহত জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকে আগত এবং তাদের লশকর-এ-ত্যয়বার সাথে যোগসূত্রের অভিযোগ রয়েছে।
পহেলগাম হামলার পেছনে রয়েছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামক জঙ্গি সংগঠন, যা পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যয়বার ছায়া সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) টিআরএফ প্রধান শেখ সাজ্জাদ গুলকে পহেলগাম হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির আবহে জন্ম নেওয়া এই সংগঠনটি ভারত সরকার ২০২৩ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
অভিযানস্থল থেকে চিনা রেডিয়ো ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। নিহত জঙ্গিদের শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলছে এবং ড্রোন ক্যামেরার মাধ্যমে সংঘর্ষস্থলের ছবি তোলা হয়েছে। সম্প্রতি এনআইএর হাতে গ্রেফতার হওয়া দুই সন্দেহভাজনকে নিহতদের ছবি দেখানো হবে পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য।
গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় ১৫০ জন জঙ্গি ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তারা কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ‘অপারেশন মহাদেব’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী পুরো এলাকাটি ঘিরে রেখে তল্লাশি অভিযান জোরদার করেছে এবং আরও জঙ্গির উপস্থিতির সন্ধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
পহেলগাম হামলার ঘটনায় ফিরে তাকালে দেখা যায়, গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পহেলগামের বৈসরন উপত্যকায় পাঁচ থেকে ছয় জন মুখোশধারী জঙ্গি অত্যাধুনিক একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করেছিল। এই হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাইফুল্লাহ খালিদ ওরফে সাইফুল্লাহ কাসুরিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি লশকরের অন্যতম প্রধান এবং ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছেন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ: পাহালগামের সন্ত্রাসী হামলার পর বদলে গেল কূটনৈতিক
‘অপারেশন মহাদেব’ নামকরণের পেছনে রয়েছে হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা মহাদেবের (শিব) নাম, যা শক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের বিভিন্ন অভিযানে এমন অর্থবহ নাম ব্যবহার করে থাকে যা সৈনিকদের মনোবল বৃদ্ধি ও জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সফল অভিযান কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপ দমনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এলাকার দুর্গম প্রকৃতি ও জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকার কৌশলের কারণে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে অভিযান এখনও সম্পূর্ণ শেষ হয়নি এবং এলাকায় আরও জঙ্গির উপস্থিতির সন্ধানে কাজ চলছে।
এই সাফল্যের মাধ্যমে পহেলগাম হামলার বদলা নেওয়ার পাশাপাশি কাশ্মীরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীর দৃঢ় অবস্থানের বার্তা পৌঁছে গেছে। স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে।