পাকিস্তানে ভারতের সফল সামরিক অভিযানের মাত্র একদিন পরেই ‘Operation Sindoor’ নামটি ট্রেডমার্ক করার জন্য ছয়টি আবেদন জমা পড়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে যখন কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, তখন সেটি বাণিজ্যিক সুযোগে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। ভারতের সামরিক বাহিনীর সাহসিকতাপূর্ণ এই অভিযান দেশজুড়ে জাতীয় গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে, আর সেই সুযোগেই অনেকে এর নাম ট্রেডমার্ক করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
Operation Sindoor Trademark: কারা আবেদন করলেন?
গত ৭ মে, ভারত সরকার পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঠাঁটিতে সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা করে। এরপরই দেখা গেল ট্রেডমার্কের জন্য আবেদনের ঢল। আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন:
- মুকেশ চেতরাম আগরওয়াল (মুম্বাই নিবাসী)
- প্রাক্তন গ্রুপ ক্যাপ্টেন কমল সিং ওবেরহ (ভারতীয় বায়ুসেনা)
- আলোক কোঠারি (দিল্লি-ভিত্তিক আইনজীবী)
- জয়রাজ টি (কোচি নিবাসী)
- উত্তম (সুরাটের বিজ্ঞাপন ফিল্ম নির্মাতা)
- রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (RIL)
উল্লেখযোগ্য যে, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ পরবর্তী সময়ে তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, এই বলে যে এটি কোনো জুনিয়র কর্মচারী দ্বারা অনুমোদন ছাড়াই ভুলবশত জমা হয়েছিল।

Operation Sindoor Trademark: আবেদনের উদ্দেশ্য কী?
ক্লাস ৪১ – বহুমুখী ব্যবহারের ক্ষেত্র
সকল আবেদনকারীই ট্রেডমার্ক ক্লাস ৪১ এর অধীনে আবেদন করেছেন। এই শ্রেণীতে পড়ে:
- শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সেবা
- চলচ্চিত্র ও মিডিয়া উৎপাদন
- ডিজিটাল প্রকাশনা এবং OTT কন্টেন্ট
- সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান
এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে আবেদনকারীরা Operation Sindoor নামটি ভবিষ্যতে সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, ডকুমেন্টারি বা অন্যান্য বিনোদনমূলক কন্টেন্ট হিসাবে ব্যবহার করতে চান। আসলে, আবেদনগুলো ‘proposed to be used’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
Operation Sindoor: সামরিক অভিযানের বিবরণ
৮ মে ২০২৫ এর প্রথম প্রহরে, ভারত বালাকোট অভিযানের পর সবচেয়ে বৃহৎ সীমান্ত-অতিক্রমী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি উচ্চ-মূল্যবান সন্ত্রাসী শিবিরকে লক্ষ্য করে এই অভিযান পরিচালিত হয়। মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন এই অভিযানে বায়ু, নৌ এবং ভূমি-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করা হয়।
সম্পূর্ণ গোপনীয়তার মধ্যে পরিচালিত এই অভিযান পাহলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয়। সরকারি সূত্র অনুসারে, জইশ-ই-মোহাম্মদ (JeM), লশকর-ই-তৈয়বা (LeT), এবং হিজবুল মুজাহিদিন সম্পর্কিত প্রায় ১০০ সন্ত্রাসী এই অভিযানে নিহত হয়েছে। আধিকারিকরা এই অভিযানকে ‘পরিমিত, সুনির্দিষ্ট এবং গোয়েন্দা-চালিত’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
Operation Sindoor Trademark: আইনি দিক
ট্রেডমার্কের অনন্যতা
দিল্লি হাইকোর্টের একজন বৌদ্ধিক সম্পত্তি আইনজীবী NDTV-কে জানিয়েছেন যে, ট্রেডমার্ক আইন অনুসারে সরকারি অভিযান সম্পর্কিত ট্রেডমার্কের জন্য আবেদন করতে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। তিনি বলেন, “এটা সবসময়ই একটি প্রতিযোগিতা – যিনি প্রথম আবেদন করেন, তার সুবিধা থাকে।”
এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতে সামরিক অভিযানের নামগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৌদ্ধিক সম্পত্তি হিসাবে সুরক্ষিত নয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সাধারণত এই ধরনের শব্দগুলির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিবন্ধন বা সীমাবদ্ধ করে না, যার ফলে এগুলি ব্যক্তিগত ট্রেডমার্ক দাবির জন্য অসুরক্ষিত থাকে।
তবে ট্রেডমার্ক আইন, ১৯৯৯ অনুযায়ী, রেজিস্ট্রি আবেদনগুলি প্রত্যাখ্যান করতে পারে যদি শব্দটি:
- বিভ্রান্তিকর, আপত্তিকর, বা জনস্বার্থবিরোধী হয় (ধারা ৯)
- সরকার বা জাতীয় প্রতিরক্ষার সাথে মিথ্যা সম্পর্ক ইঙ্গিত করে (ধারা ১১)

রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের দৃষ্টিভঙ্গি
আবেদন প্রত্যাহার এবং ব্যাখ্যা
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ৮ মে একটি বিবৃতি জারি করে, যেখানে তারা বলে:
“রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের Operation Sindoor ট্রেডমার্ক করার কোনো উদ্দেশ্য নেই, এটি এমন একটি শব্দ যা এখন জাতীয় চেতনার অংশ হিসেবে ভারতীয় সাহসিকতার একটি আবেগপূর্ণ প্রতীক।”
“জিও স্টুডিওস, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের একটি ইউনিট, তার ট্রেডমার্ক আবেদন প্রত্যাহার করেছে, যা অনুমোদন ছাড়াই একজন জুনিয়র ব্যক্তি দ্বারা ভুলবশত দায়ের করা হয়েছিল।”
“রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এর সকল স্টেকহোল্ডার পাহলগামে পাকিস্তান-প্রায়োজিত সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় Operation Sindoor নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। Operation Sindoor আমাদের সাহসী সশস্ত্র বাহিনীর গর্বের বিষয় যা সন্ত্রাসবাদের অনিষ্টের বিরুদ্ধে ভারতের আপোষহীন লড়াইয়ের অংশ। রিলায়েন্স সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমাদের সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ সমর্থনে দাঁড়িয়ে আছে। ‘INDIA FIRST’ মূলমন্ত্রের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি অপরিবর্তনীয়।”
Operation Sindoor Trademark: ক্যাচি লোগো এবং ছবির জন্য দাবি
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, কিছু আবেদনকারী শুধু নাম নয়, ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত অফিসিয়াল লোগোর জন্যও ট্রেডমার্ক দাবি করেছেন। মুকেশ আগরওয়াল এবং জয়রাজ T উভয়েই ওয়ার্ডমার্কের পাশাপাশি ছবির জন্যও ট্রেডমার্ক চেয়েছেন।
জয়রাজ T-এর আবেদনে ‘Operation Sindoor – Sindoora Yuddham’ নামের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা প্রকাশিত অপারেশন নামের ছবির একটি পরিবর্তিত সংস্করণের ওপরও অধিকার চাওয়া হয়েছে, যেখানে অতিরিক্তভাবে ‘Sindoora Yuddham’ উল্লেখ করা হয়েছে।
Operation Sindoor Trademark: বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
ট্রেডমার্ক ক্লাস ৪১-এর আবেদন স্পষ্ট করে যে আবেদনকারীরা এই নামটিকে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যবহার করতে চান। বিশেষত:
- চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ, বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ
- ডিজিটাল প্রকাশনা
- শিক্ষামূলক সামগ্রী
- বিনোদন অনুষ্ঠান
সুরাটের বিজ্ঞাপন নির্মাতা উত্তম জাজু, যিনি সম্প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়েছেন, ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে তিনি “একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য আলোচনায় আছেন”।
শেষ কথা: Operation Sindoor Trademark নিয়ে জাতীয় চেতনার প্রশ্ন
Operation Sindoor নামটি এখন দেশের মানুষের কাছে জাতীয় সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মতো বড় সংস্থার এই নাম ট্রেডমার্ক করার প্রয়াস থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় যে এই নামটি জাতীয় চেতনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
এই ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই, যখন কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে, তখন সেটিকে ঘিরে বাণিজ্যিক সুযোগ কাজে লাগানোর প্রবণতাও তৈরি হয়। তবে সেই সুযোগ গ্রহণের সময় জাতীয় আবেগ ও মর্যাদাকে সম্মান দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা অভিযানের নাম ট্রেডমার্ক করার ক্ষেত্রে আইনি বাধা না থাকলেও, এটা নৈতিক প্রশ্ন তোলে যে এই ধরনের নাম একচেটিয়াভাবে ব্যবহারের অধিকার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত কিনা।
Operation Sindoor Trademark নিয়ে এই প্রতিযোগিতা আমাদের জাতীয় গর্ব এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। ভবিষ্যতে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রি কীভাবে এই আবেদনগুলি দেখে, তা দেখার বিষয়।