World’s tallest bridges ranking: পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও চ্যালেঞ্জিং অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে গভীর পাইল ফাউন্ডেশন সহ দীর্ঘতম সেতু হিসেবে রেকর্ড করেছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করেছে।পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে এবং ২০২২ সালের জুন মাসে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই সেতুর নির্মাণে প্রায় ৩০,১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে। এটি একটি দ্বিতল স্টিল ট্রাস সেতু, যার উপরের তলায় রয়েছে চার লেনের হাইওয়ে এবং নিচের তলায় রয়েছে একটি সিঙ্গেল ট্র্যাক রেলপথ।
পদ্মা সেতুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর পাইল ফাউন্ডেশনের গভীরতা। এই সেতুর পাইল ফাউন্ডেশন ১২৭ মিটার (৪১৭ ফুট) গভীর, যা বিশ্বের যেকোনো সেতুর তুলনায় সবচেয়ে গভীর। এই গভীর ফাউন্ডেশন পদ্মা নদীর প্রবল স্রোত এবং নদীতলের ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সেতুকে সুরক্ষা প্রদান করে।পদ্মা সেতুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু। এর প্রস্থ ২২ মিটার (৭২ ফুট), যা চার লেনের হাইওয়ে এবং একটি রেলপথ ধারণ করতে সক্ষম।
বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতু যে ভাবে বদলে দেবে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা
সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০.১২ মিটার (৪৯২.৫ ফুট)।পদ্মা সেতু শুধুমাত্র একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে এই সেতু বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.২৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। দেশের ২১টি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা, যেগুলোর অধিকাংশেরই গড় দারিদ্র্যের হার দেশের গড়ের চেয়ে বেশি, তারা এই সেতুর মাধ্যমে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত হবে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে, গড়ে প্রতিদিন ১৫,০০০ এরও বেশি যানবাহন এই সেতু দিয়ে চলাচল করছে। এর ফলে যাতায়াত সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আগে ফেরিতে করে পদ্মা নদী পার হতে ১৫ থেকে ২২ ঘণ্টা সময় লাগত, যা এখন মাত্র কয়েক মিনিটে সম্ভব হচ্ছে।পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেনি, এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সেতুর দুই পাশে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বড় কোম্পানি এই অঞ্চলে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন শুরু করেছে।পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও উন্নত করেছে। এটি ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (N-8) এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের ভারত, ভুটান ও নেপালের সাথে আন্তর্জাতিক সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পদ্মা সেতুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা। এটি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। সেতুর পাইলগুলো ৩ মিটার ব্যাসের টিউবুলার স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা নদীতলে ৪০০ ফুটেরও বেশি গভীরে প্রোথিত করা হয়েছে। এছাড়াও সেতুতে ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে, যা ভূমিকম্পের সময় সেতুর কাঠামোকে সুরক্ষা প্রদান করবে।পদ্মা সেতু শুধু যানবাহন চলাচলের জন্যই নয়, এটি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা সেবাও বহন করছে। সেতুতে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং ১১৩৫ পিএসআই গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও সেতুতে ফাইবার অপটিক যোগাযোগ ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছে।পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেতুর দুই প্রান্তে মাওয়া ও জাজিরায় নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
Copa America: ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল মহাযজ্ঞের মজাদার তথ্যাবলী
এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র যেমন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু মাজার ইত্যাদি স্থানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে।পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নদী শাসন কাজ। এই কাজের মাধ্যমে প্রায় ৯,০০০ হেক্টর জমি নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। নদী শাসন কাজে প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু এর সফল বাস্তবায়ন দেশের আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
পদ্মা সেতু শুধু একটি ভৌত অবকাঠামো নয়, এটি বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক। এটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও উন্নয়নের একটি মাইলফলক। পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু দুটি ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করেনি, বরং একটি জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন