Hilsa fish availability in Kolkata: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেও বাঙালির পাতে পদ্মার ইলিশ তুলে আনার স্বপ্ন দেখছেন পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য আমদানিকারকরা। বাংলার ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এই মাসেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আমদানির অনুমতি চাইবে। শুধু চিঠি নয়, একটি প্রতিনিধিদলও পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের, যাতে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। এই প্রেক্ষাপটে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশও ইলিশ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাঙালির প্রিয় এই মাছটি আরও দুর্লভ হয়ে উঠতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস জানিয়েছেন, গত বছর ৫ হাজার টন ইলিশ আমদানির জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। দুর্গাপুজোর সময়ে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে মাত্র ৬০০ থেকে ৮০০ টনের মতো ইলিশ এসেছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে এবার আগেভাগেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সমিতির সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদের মতে, প্রতি বছর দুর্গাপুজোর মুখে বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয়। কিন্তু সেই সময়ে বাংলাদেশে বেশি ইলিশ পাওয়া যায় না। এই কারণেই এবার আগেভাগে অনুমতি পাওয়ার জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের নীতিমালা অনুযায়ী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইলিশ মাছ শর্ত-সাপেক্ষে রপ্তানি-যোগ্য পণ্যের তালিকায় রয়েছে। তাই সরকারের অনুমোদন ছাড়া ইলিশ রপ্তানির সুযোগ সেখানে নেই। ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতীয় রপ্তানি নীতিতে (২০১৫-১৮) ইলিশ মাছ শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় রাখা হয়।
গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ দেখলে স্পষ্ট হয় যে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন যে, দেশের বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেন দেশের মানুষের কাছে ইলিশ আরও সহজলভ্য হয়।
তবে পরবর্তীতে দুর্গাপুজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ৩ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এমনকি আইনি নোটিশও পাঠানো হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে ভারতের বিশাল ও বিস্তৃত সমুদ্রসীমা রয়েছে এবং ভারতের জলসীমায় ব্যাপক ইলিশ উৎপাদন হয়, তাই বাংলাদেশ থেকে ভারতের ইলিশ মাছ আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই।
ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু করে। প্রথম বছর প্রতি কেজি ইলিশ ৬ ডলার দরে রপ্তানি হয়েছিল, পরে তা প্রতি কেজি ১০ ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭ টন ইলিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল সাড়ে ৩৯ লাখ ডলার।
রপ্তানির পরিমাণ দেখলে বোঝা যায় যে, চার বছরে ভারতে ৫ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে, যা মোট ইলিশ উৎপাদনের মাত্র দশমিক ৫ ভাগেরও কম। এ থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৩৯ হাজার কোটি টাকা। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ সরকার যে পরিমাণ রপ্তানির অনুমোদন দেয়, তার কম ইলিশ যায় ভারতে।
বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম এখন ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। আর ৭০০-৮০০ গ্রামের ইলিশের দামও ১ হাজার ১০০ টাকার মতো। এই উচ্চ মূল্যের কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রান্তিক শ্রেণির অনেকের কাছে ইলিশ কেনা বিলাসিতা।
অন্যদিকে ভারতীয় বাজারে পরিস্থিতি আরও জটিল। বাংলাদেশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় কলকাতায় ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার আর দিল্লিতে তিন হাজার রুপিতে। দিল্লির সিআর পার্ক মার্কেটের মাছের আড়তের মালিকরা জানিয়েছেন যে, তারা অবৈধভাবে ইলিশ মাছ কিনে তিন হাজার রুপি কেজি দরে বিক্রি করছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইলিশ এখন শুধু জাতীয় সম্পদই নয়, কূটনীতির অংশেও পরিণত হয়েছে। দুর্গাপূজায় সীমিত পরিসরে ইলিশ রপ্তানি প্রতিবেশী দেশের কাছে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে এবং দুই দেশের বাণিজ্যিকসহ কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির ওপর। বাঙালির পাতে পদ্মার ইলিশ ফেরানোর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।