পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের পারমাণবিক হুমকিতে ভারতের তীব্র নিন্দা: আমেরিকার মাটিতে বিপজ্জনক বক্তব্য

Chanchal Sen 6 Min Read

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির আমেরিকা সফরকালে ভারতের বিরুদ্ধে দেওয়া পারমাণবিক হুমকির তীব্র নিন্দা করেছে নয়াদিল্লি। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ট্যাম্পায় অনুষ্ঠিত এক পাকিস্তানি প্রবাসী সমাবেশে মুনির ভারতের বিরুদ্ধে ভয়াবহ পারমাণবিক হুমকি দিয়ে বলেছেন, “আমরা একটি পারমাণবিক শক্তি। যদি আমরা মনে করি আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি, তাহলে অর্ধেক পৃথিবীকে আমাদের সাথে নিয়ে যাব।” ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রক এই মন্তব্যকে “পারমাণবিক তরবারি নাচানো” বলে অভিহিত করে জানিয়েছে যে, দেশ পারমাণবিক হুমকির কাছে নতি স্বীকার করবে না এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

গত সোমবার (১১ আগস্ট) ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের এই হুমকিকে “অত্যন্ত দায়িত্বহীন” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “পারমাণবিক তরবারি নাচানো পাকিস্তানের পুরোনো অভ্যাস। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ধরনের মন্তব্যের দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে, যা এমন একটি রাষ্ট্রে পারমাণবিক কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণের সততা নিয়ে দীর্ঘদিনের সন্দেহকে আরও শক্তিশালী করে যেখানে সামরিক বাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে।”

বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হলো মুনিরের এই হুমকি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ তৃতীয় দেশের মাটি থেকে এসেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রক এই বিষয়ে “দুঃখ” প্রকাশ করে বলেছে যে, “এটি দুর্ভাগ্যজনক যে এই মন্তব্যগুলো একটি বন্ধুত্বপূর্ণ তৃতীয় দেশের মাটি থেকে করা হয়েছে।” এই ঘটনাটি প্রথমবারের মতো আমেরিকার মাটিতে কোনো তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

ভারতের সামরিক শক্তি বাংলাদেশের ১০ গুণ বেশি: তুলনামূলক বিশ্লেষণ

সরকারি সূত্র অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানদের এই ধরনের বিবৃতি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। তারা বলেছেন, “যখনই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে, তখনই তারা তাদের আসল রূপ প্রকাশ করে।” এই সূত্রগুলো আরও জানায়, “এটি এমন একটি উপসর্গ যা দেখায় যে পাকিস্তানে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই; এখানে সামরিক বাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে।”

ট্যাম্পায় অনুষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী আদনান আসাদের আয়োজিত নৈশভোজে মুনির শুধু পারমাণবিক হুমকিই দেননি, বরং সিন্ধু নদের পানি প্রসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকিও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ভারতের বাঁধ তৈরির অপেক্ষায় থাকব এবং যখন তারা তা করবে, তখন আমরা দশটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তা ধ্বংস করে দেব। সিন্ধু নদ ভারতীয়দের পারিবারিক সম্পত্তি নয়। আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রের কোনো অভাব নেই, আলহামদুলিল্লাহ।”

আরও চিন্তার বিষয় হলো, মুনির তার পারমাণবিক আক্রমণ পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ভারতের পূর্ব দিক থেকে শুরু করব, যেখানে তারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ স্থাপন করেছে এবং তারপর পশ্চিম দিকে এগোব।” এই ধরনের সুনির্দিষ্ট হুমকি দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুনিরের এই বিবৃতির পেছনে রয়েছে সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। গত এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পহলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সিন্ধু জল চুক্তির কিছু অংশ স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। এই হামলায় ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার অঙ্গসংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রক অবশ্য ভারতের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে। তারা মুনিরের মন্তব্যকে “প্রসঙ্গের বাইরে বিকৃত” বলে অভিহিত করেছে এবং দাবি করেছে যে পাকিস্তান একটি “দায়িত্বশীল পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র”। পাকিস্তানি মুখপাত্র বলেছেন, “পাকিস্তানের একটি বিস্তৃত কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কাঠামো রয়েছে যা সম্পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন।”

বিশ্ব রাজনীতির নতুন চালক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: পরমাণু যুদ্ধের চাবিকাঠি কি তবে AI-এর হাতে?

তবে ভারতীয় সূত্রগুলো এই দাবি খারিজ করে বলেছে যে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র অরাষ্ট্রীয় অভিনেতাদের হাতে পড়ার “প্রকৃত ঝুঁকি” রয়েছে। তারা পাকিস্তানের “ব্যর্থ গণতন্ত্র” এবং “সন্ত্রাসের সমস্যা” উল্লেখ করে বলেছে যে সেখানে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মুনিরের এই হুমকিকে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছেন। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) এর ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের “অর্ধেক পৃথিবী ধ্বংস” করার মতো বৈশ্বিক পারমাণবিক আঘাতের ক্ষমতা নেই।

গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দশক প্রাচীনতম সংঘাতের পর এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। সেই সময়ও পাকিস্তান একাধিকবার পারমাণবিক হুমকি দিয়েছিল, যা ভারত প্রত্যাখ্যান করেছিল। এবারের ঘটনা আরও উদ্বেগজনক কারণ এটি আমেরিকার মাটিতে এবং একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হয়েছে।

ভারত তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে জানিয়েছে যে দেশ কোনো পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের কাছে নতি স্বীকার করবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ভারত পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের কাছে মাথা নত করবে না এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে থাকবে।”

বর্তমানে পাকিস্তান অভ্যন্তরীণভাবেও নানা সংকটের মুখে রয়েছে। আফগানিস্তানের সাথে সীমান্তে ঘন ঘন সংঘর্ষ, ইরানের সাথে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং বেলুচিস্তানে ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের মতো সমস্যা রয়েছে। এছাড়াও ২৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশি ঋণের বোঝা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

এই পরিস্থিতিতে মুনিরের পারমাণবিক হুমকি পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানের “দায়িত্বশীল পারমাণবিক শক্তি” হিসেবে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে এই ধরনের উস্কানিমূলক বিবৃতি আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

উল্লেখ্য, এই ঘটনা হিরোশিমা-নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা হামলার ৮০তম বার্ষিকীর সময়ে ঘটেছে, যা বিষয়টিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির এই সময়ে মুনিরের মন্তব্য বিশেষভাবে নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।

ভারত স্পষ্ট করেছে যে দেশ কোনো প্রকার পারমাণবিক হুমকি বা ব্ল্যাকমেইলের কাছে নতি স্বীকার করবে না। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ভারত সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত রয়েছে। এই ঘটনা দুই পারমাণবিক প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

Share This Article