দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের বাদর এলাকায় শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ভোর ৪টায় পাকিস্তানি তালেবানদের (টিটিপি) হামলায় কমপক্ষে ১২ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছেন। সশস্ত্র জঙ্গিরা সামরিক কনভয়ের উপর চারদিক থেকে ভারী অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়, যার ফলে ১২ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত এবং ৪ জন আহত হন। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হামলার দায়ভার স্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে যে তারা নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও ড্রোন দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
আফগানিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই হামলাটি ২০২১ সালে আফগান তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে চলমান সহিংসতার অংশ। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মতে, হামলাকারীরা টিটিপির ‘ফিতনা আল খওয়ারিজ’ দলের সদস্য যারা আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। ঘটনাস্থলের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে হামলার পর কয়েক ঘণ্টা ধরে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন যা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইসলামাবাদ দাবি করেছে যে আফগান তালেবান প্রশাসন পাকিস্তানি তালেবানদের আশ্রয় দিচ্ছে, যদিও কাবুল এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বিবৃতিতে বলেছে, “পাকিস্তান আশা করে যে অন্তর্বর্তী আফগান সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদের ভূমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেবে না”।
এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি বাহিনী দুটি পৃথক অভিযানে টিটিপির বিরুদ্ধে সফল অপারেশন চালিয়েছিল। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চালানো এই অভিযানে বাজাউর জেলায় ২২ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে, যেখানে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে আরও ১৩ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩৫ জন টিটিপি জঙ্গি এই দুটি অভিযানে নিহত হয়েছে।
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান জেলাটি পাকিস্তানের সবচেয়ে অস্থির এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত দুর্গম, পাহাড়ি ও জটিল ভূমি যা জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য আদর্শ আশ্রয়স্থল। ৬,৬২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জেলাটি আফগানিস্তানের সাথে প্রায় ৭০ কিলোমিটার সীমানত ভাগাভাগি করে। এই এলাকাটি পূর্বে ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াস (ফাটা) এর অংশ ছিল এবং ২০১৮ সালে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সাথে একীভূত হয়েছে।
টিটিপির উত্থান ২০০৭ সালে বৈতুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। বর্তমানে নূর ওয়ালী মেহসুদের নেতৃত্বাধীন এই সংগঠনটি পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করে শরিয়া আইনভিত্তিক একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে টিটিপির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে পাকিস্তানে সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েত উভয় দেশই এই সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তান সরকার ও নিহত সেনাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে। দেশগুলো তাদের বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের সকল রূপের বিরোধিতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, ২০২২ সালে নভেম্বরে টিটিপি একতরফাভাবে পাকিস্তান সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতি বাতিল করার পর থেকে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। তারপর থেকে এই সংগঠনটি সারাদেশে হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে, ফলে খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তান প্রদেশে সহিংসতা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ২০২৪ সালটি ছিল পাকিস্তানের জন্য প্রায় দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বছর। ইসলামাবাদভিত্তিক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১,৬০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকই সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে সশস্ত্র দলগুলোর হামলায় প্রায় ৪৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে টিটিপির কার্যকলাপ কেবল পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। জাতিসংঘের একটি ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানে প্রায় ৬,০০০ থেকে ৬,৫০০ টিটিপি যোদ্ধা রয়েছে যারা আফগানিস্তানের মাটি থেকে পাকিস্তানে হামলা পরিচালনা করছে। প্রতিবেদনটি আরো সতর্ক করেছে যে টিটিপি অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে একটি ছাতা সংগঠনে পরিণত হতে পারে।
পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে ‘আজম-ই-ইস্তেখাম‘ (স্থিতিশীলতার সংকল্প) নামে একটি বিস্তৃত সামরিক অভিযান শুরু করেছে যা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি এবং আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে আসা সশস্ত্র বিদ্রোহের মোকাবেলায় কেন্দ্রীভূত। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে শুধুমাত্র সামরিক পদক্ষেপ দিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের অভিযোগ যে আফগান তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং ভারতের সমর্থনে তারা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে, যদিও কাবুল এবং নয়াদিল্লি উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে শনিবারের এই হামলা পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যে কতটা গুরুতর হয়ে উঠেছে তারই প্রমাণ। সামরিক বাহিনীর পাল্টা অভিযান সত্ত্বেও টিটিপি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে, যা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।