বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কূটনৈতিক এবং সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশের বিষয়ে নীতিগত চুক্তিতে পৌঁছেছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী মহসিন নকভি এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মধ্যে এই ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং ভারতের জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, “কূটনৈতিক এবং সরকারি পাসপোর্টধারীদের ভিসামুক্ত প্রবেশের সুবিধা প্রদানে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে এবং উভয় দেশ এই বিষয়ে নীতিগত চুক্তিতে পৌঁছেছে”। তবে এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি।
দুই দেশের মধ্যে এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে নতুন উষ্ণতা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত নিজেকে একটি কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে দেখতে পাচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তার ঐতিহাসিক প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে।
বৈঠকে দুই দেশের কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, পুলিশি প্রশিক্ষণ, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মানব পাচার রোধে সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। নতুন উদ্যোগসমূহ পরিচালনা ও সমন্বয়ের জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সচিব খুররাম আগা।
ভারতের জন্য এই চুক্তির প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কূটনৈতিক একাধিপত্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত বাংলাদেশকে তার নিকটতম মিত্র হিসেবে বিবেচনা করত, বিশেষ করে শেখ হাসিনার আমলে। কিন্তু হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে।
বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। দুই দেশই পরস্পরের নাগরিকদের ভিসা স্থগিত করেছে এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-বাংলাদেশের ভিসামুক্ত চুক্তি ভারতের জন্য আরও উদ্বেগের কারণ। এটি দুইভাবে ভারতকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রথমত, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন কূটনৈতিক অক্ষ তৈরি করতে পারে যা ভারত-বিরোধী অবস্থান নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে।
পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই উন্নতির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জটিল ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উভয় দেশ সম্পর্ক পুনর্গঠনে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর আগে মে মাসে বাংলাদেশের পাকিস্তানে নিযুক্ত হাইকমিশনার জানিয়েছিলেন যে, ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ভিসা ব্যবস্থা সহজীকরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নকভিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং এই সফরকে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। “আমাদের দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য আপনার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” পাকিস্তানের বিবৃতি অনুযায়ী তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
পুলিশ একাডেমির জন্য বিনিময় কর্মসূচি শুরু করার বিষয়েও দুই দেশ সম্মত হয়েছে। শীঘ্রই বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদের ন্যাশনাল পুলিশ একাডেমি পরিদর্শন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ধরনের সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।
ভৌগোলিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, এই চুক্তি ভারতের জন্য নিরাপত্তা উদ্বেগও তৈরি করতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকে ভারত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। পাকিস্তানের সাথে চলমান উত্তেজনার পাশাপাশি এখন বাংলাদেশের সাথেও সম্পর্কের অবনতি ভারতকে একটি কঠিন অবস্থানে ফেলেছে।
এদিকে, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই বাংলাদেশিদের জন্য সকল ধরনের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনলাইন ভিসা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। এটি দুই দেশের মধ্যে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি করবে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাও বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে চীন এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে। চীন ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে।
ভারতের কূটনৈতিক মহলে এই উন্নয়ন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ এটি শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয় নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি সমীকরণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। ভারত যদি এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আঞ্চলিক নেতৃত্বে তার অবস্থান দুর্বল হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক ভিসামুক্ত চুক্তি ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি ভারতকে তার আঞ্চলিক নীতি পুনর্বিবেচনা করতে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে।