মাত্র কয়েকঘন্টা আগে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আবারও উত্তেজনা। শনিবার (১০ মে, ২০২৫) ভারত ও পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি অভিযোগ করেছেন যে “বারবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘন” করেছে পাকিস্তান, যা তারা “অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে” দেখছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতা তারার সরাসরি এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির কোনো লঙ্ঘন হয়নি।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি চুক্তি: মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
শনিবার দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান সকল সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে এই সংবাদ প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় একটি দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর, আমি খুশির সাথে ঘোষণা করছি যে ভারত ও পাকিস্তান একটি সম্পূর্ণ ও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। উভয় দেশকে তাদের সাধারণ জ্ঞান ও মহান বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য অভিনন্দন।”
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারও একই সংবাদ নিশ্চিত করে একস প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেন, “পাকিস্তান ও ভারত অবিলম্বে কার্যকর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান সর্বদা অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চেয়েছে, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা সম্পর্কে কোনো আপস ছাড়াই!”
ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির মতে, উভয় পক্ষের সামরিক পরিচালনা পরিচালকদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে এই সমঝোতা হয়েছে এবং তারা “স্থল, বায়ু এবং সমুদ্র থেকে সমস্ত গুলি চালানো এবং সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার” সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৫টা থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
বারবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ: ভারতের অবস্থান
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই, জম্মু-কাশ্মীরের প্রধান শহরগুলিতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রয়টার্স-এর সাক্ষীরা এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে শ্রীনগর ও জম্মুতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং জম্মুর আকাশে প্রক্ষেপণাস্ত্র ও আলোর ঝলকানি দেখা গেছে, যা আগের রাতের ঘটনার অনুরূপ।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি একটি দ্রুত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “গত কয়েক ঘণ্টা ধরে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক পরিচালনা পরিচালকদের মধ্যে আজ সন্ধ্যায় যে সমঝোতা হয়েছিল তার বারবার লঙ্ঘন হয়েছে। এটি আজ আগে অর্জিত সমঝোতার লঙ্ঘন। সশস্ত্র বাহিনীগুলি এই লঙ্ঘনগুলির পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে এবং আমরা এই লঙ্ঘনগুলিকে খুব, খুব গুরুত্বের সাথে দেখি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা পাকিস্তানকে এই লঙ্ঘনগুলি মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে এবং পরিস্থিতি গুরুত্ব ও দায়িত্বের সাথে মোকাবেলা করার আহ্বান জানাই। সশস্ত্র বাহিনীগুলি পরিস্থিতির উপর শক্তিশালী নজরদারি বজায় রাখছে। তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা উভয় সীমান্তেই লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
পাকিস্তানের অস্বীকার: কোনো লঙ্ঘন হয়নি
পাকিস্তান কিন্তু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতা তারার জিও নিউজকে জানিয়েছেন যে এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কোনো লঙ্ঘন হয়নি।
উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ওয়াশিংটন থেকে আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে, নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাহার খান বলেছেন যে অভিযোগযুক্ত লঙ্ঘনগুলি নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর শান্তির ভঙ্গুর প্রকৃতি তুলে ধরে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে সাম্প্রতিক শত্রুতাগুলি ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, যা ২০০৩ সাল থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল।
বিভিন্ন অঞ্চলে ড্রোন আক্রমণের অভিযোগ
ভারতের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর, গুজরাটের কচ্ছ, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানের বিভিন্ন অংশে ড্রোন দেখা যাওয়ার খবর রয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমসের মতে, ভারতের বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ কয়েকটি ড্রোন প্রতিহত করেছে।
এছাড়া, বিভিন্ন জেলায় সাইরেন বাজানো হচ্ছে, ব্ল্যাকআউট প্রবর্তন করা হচ্ছে এবং জনসাধারণকে ঘরের ভিতরে থাকতে বলা হচ্ছে। ভারতীয় বায়ুসেনা জানিয়েছে যে তারা স্বাভাবিক সতর্কতা অবস্থায় আছে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রস্তুত।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ
দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এপ্রিল ২২, ২০২৫-এ ভারত-প্রশাসিত কাশ্মীরের পাহলগামে এক জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক (অধিকাংশই হিন্দু ভারতীয় পর্যটক) নিহত হন। ভারত পাকিস্তানকে এই হামলায় সহায়তা করার অভিযোগ করে, যা ইসলামাবাদ প্রত্যাখ্যান করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, ৭ মে, ২০২৫-এ ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে একটি অভিযান চালায়, যাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি “সন্ত্রাসী ক্যাম্পে” লক্ষ্যবদ্ধ হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানের মতে, এই হামলায় ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। পাকিস্তান দাবি করে যে তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
পরবর্তী দিনগুলিতে উভয় দেশের মধ্যে ক্রস-বর্ডার গোলাগুলি, শেলিং এবং ড্রোন ও মিসাইল আক্রমণ চলতে থাকে, যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমদ শরিফ জানান যে ভারতীয় মিসাইলগুলি রাওয়ালপিন্ডিতে নুর খান বিমান ঘাঁটি, চাকওয়াল শহরে মুরিদ বিমান ঘাঁটি এবং পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের ঝাং জেলায় রফিকি বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্য করেছিল।
বারবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও, উভয় দেশের মধ্যে সেনা যোগাযোগ লাইন চালু রাখা হয়েছে এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন যে উভয় পক্ষের শীর্ষ সামরিক আধিকারিকরা ১২ মে আবার কথা বলবেন।
ভারত-পাকিস্তান বিরোধের পটভূমি
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘকালীন বিরোধ রয়েছে। উভয় দেশই সমগ্র কাশ্মীরকে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে দাবি করে, তবে প্রত্যেকে এর একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। অঞ্চলটির আরেকটি উত্তর-পূর্ব অংশ চীন দ্বারা প্রশাসিত, যা দীর্ঘকাল ধরে দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে ঘর্ষণের বিষয় হয়ে আছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, ভারত ও পাকিস্তান চারটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে (১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯)। এছাড়াও, কার্গিল সংঘর্ষ সহ বেশ কয়েকটি কম তীব্রতার সংঘর্ষও হয়েছে। বর্তমান উত্তেজনা পরিস্থিতি শেষ বড় সংঘর্ষের ২৬ বছর পরে সংঘটিত হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধবিরতি চুক্তির ভবিষ্যৎ
বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক উদ্বেগ দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও, প্রায় ৩৬টি দেশ চুক্তি চূড়ান্ত করতে সহায়তা করেছে বলে জানা গেছে। দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ক্ষণিকের উদ্বেগ ছিল, কারণ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইঙ্গিত দিয়েছিল যে পারমাণবিক অস্ত্র তত্ত্বাবধান করে এমন একটি মূল কমিটি বৈঠক করতে যাচ্ছে। তবে, পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট করেন যে তীব্র যুদ্ধের একটি রাতের পরে, যাতে বেড়ে যাওয়া হতাহতের সংখ্যার সাথে মোট বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ৬৬-এ পৌঁছেছে, এমন কোন বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয়নি।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও, ভারত সরকারের দুটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে যে ভারত দ্বারা পূর্বে ঘোষিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যা পাকিস্তান দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছে, যেমন বাণিজ্য বন্ধ এবং ভিসা বাতিল, আপাতত বহাল থাকবে। তারা আরও উল্লেখ করেছেন যে ১৯৬০ সালের ইন্দুস চুক্তি, একটি গুরুত্বপূর্ণ জল-ভাগাভাগি চুক্তি যা ভারত কাশ্মীর আক্রমণের পর স্থগিত করেছিল, তা নিষ্ক্রিয় থাকবে।
বারবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘনের ফলাফল
যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন ঘটনাগুলি উভয় দেশের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির অসম্ভাব্যতা প্রকাশ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের লঙ্ঘন উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনার তীব্রতা বাড়াতে পারে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এই ধরনের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনে। রাজৌরিতে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে অতিরিক্ত জেলা উন্নয়ন কমিশনার রাজ কুমার থাপা নিহত হয়েছেন, যা সীমান্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তুলে ধরে।
সামনের পথ: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
বারবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও, কূটনৈতিক চ্যানেলগুলি খোলা রাখা হয়েছে। উভয় দেশের সামরিক নেতৃত্ব ১২ মে আবার যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ইতিবাচক উন্নয়ন হিসাবে দেখা হচ্ছে।
তবে, বাণিজ্য স্থগিত এবং ভিসা বাতিলের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগুলি বহাল থাকা উভয় দেশের মধ্যে অবিশ্বাসের গভীরতা প্রকাশ করে। ইন্দুস জল চুক্তি স্থগিত থাকা, যা উভয় দেশের মধ্যে জল ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, আরও প্রমাণ করে যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে দীর্ঘকালীন শান্তি অর্জনের জন্য উভয় দেশকে বিশ্বাস গঠন করতে হবে এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলি, বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যা, সমাধানের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় শক্তিগুলি, এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি যদিও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে বারবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং পাল্টা অস্বীকার প্রমাণ করে যে স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।